কেবলই দৃশ্যের জন্ম! তবু, দরজা খুলবে কি?

সাম্প্রতিক অতীতে কেউ-কেউ বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, এবং হাতে-কলমে করেওছেন। এ-লেখার সূচনায় সেই কাজটিই আর-একবার করে ফেলা যাক।

আসুন, প্রহর-এ প্রকাশিত, ‘মৃত মাকে জাগাতে চাইছে ছোট্ট শিশু, বিহারে পরিযায়ী শ্রমিক মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনের এই অনুচ্ছেদে চোখ রাখি—

“সাম্প্রতিক লকডাউনের জেরে বিভিন্ন সময় সমস্যায় পড়তে দেখা গিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। ভিনরাজ্যে উপার্জন এবং আশ্রয় হারিয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে কেউ দীর্ঘ পথ হেঁটে বা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন। পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বহু শ্রমিক। আর এই সমস্ত ঘটনার নৃশংসতাকেই ছাড়িয়ে গেল বিহারের এই ঘটনা। 

স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এতগুলো মৃত্যুর দায় কার? অসহায় অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের সামান্য নিরাপত্তাও কি নিশ্চিত করতে পারি না সকলে মিলে? কিন্তু এসব তো বাইরের কথা। শিশুটি যখন টের পেল তার মা আর জাগবে না, তার মনে যে অভিমান জন্মাল, তা ঘোচাবে কে?”  (২৮ মে, ২০২০)

আরও পড়ুন
ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের ১০ শতাংশের শরীরেই মিলেছে ভাইরাস, দাবি স্বাস্থ্য দপ্তরের

এবার, অনুচ্ছেদের ‘পরিযায়ী শ্রমিক’, ‘অভিবাসী শ্রমিক’ শব্দগুলিকে বদলে যদি ‘মানুষ’ ও ‘দেশবাসী’ করে নিই, তাহলে অনুচ্ছেদটি হয় এরকম— 

আরও পড়ুন
‘বাংলার সোনু সুদ’ হিসেবে নয়, নিজগুণেই পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দেব

“সাম্প্রতিক লকডাউনের জেরে বিভিন্ন সময় সমস্যায় পড়তে দেখা গিয়েছে দেশবাসীদের। ভিনরাজ্যে উপার্জন এবং আশ্রয় হারিয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে কেউ দীর্ঘ পথ হেঁটে বা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন। পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। আর এই সমস্ত ঘটনার নৃশংসতাকেই ছাড়িয়ে গেল বিহারের এই ঘটনা। 

আরও পড়ুন
জায়গা নেই কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে, গ্রামে ঢুকতে বাধা, জঙ্গলই ঠিকানা পরিযায়ী শ্রমিকের

স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এতগুলো মৃত্যুর দায় কার? অসহায় দেশবাসীর জীবনের সামান্য নিরাপত্তাও কি নিশ্চিত করতে পারি না সকলে মিলে? কিন্তু এসব তো বাইরের কথা। শিশুটি যখন টের পেল তার মা আর জাগবে না, তার মনে যে অভিমান জন্মাল, তা ঘোচাবে কে?”

আরও পড়ুন
আবার দুর্ঘটনা বর্ধমান স্টেশনে, ভেঙে পড়ল চাঙড়, আহত পরিযায়ী শ্রমিক

ভাবনার এই সামান্য রদবদল আমাদের এই সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়, যে, যে-শ্রমিক মারা গেলেন, যে-শ্রমিক মৃত শিশুর কান্না শুনে মাঝ রাস্তায় ভেঙে পড়লেন, যে-বালিকা বাড়ির প্রায় চৌকাঠে এসেও ঘরে পা রাখতে পারলেন না, তাঁদের ‘পরিযায়ী’, ‘অভিবাসী’ যে-অভিধাতেই ভূষিত করি না কেন, আসলে তাঁরা আমারই দেশের মানুষ; পাশের মানুষ; সর্বোপরি মানুষ। অর্থাৎ, এই সংক্রান্ত যা সমস্যা, যাকে রাষ্ট্রনীতি ‘পরিযায়ীর সমস্যা’ বলে দেখিয়ে থাকে, তা একজন মানুষেরই সমস্যা; তাঁর বেঁচে থাকার সংকট। সেই সংকটের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে, একজন মানুষ হয়েই। ঠিক এই বোধ থেকেই বিশ্বব্যাপী শরণার্থী-সমস্যার দিকে আমরা চোখ ফেরাতে পারি।

আরও পড়ুন
লকডাউনে প্রাণ হারিয়েছেন ২০০ পরিযায়ী শ্রমিক, বাড়ি ফেরা স্বপ্নই থেকে গেছে অনেকের

আজ, এই মিডিয়ানন্দিত বিশ্বে শরণার্থীদের লাঞ্ছনা আমাদের অজানা নয়। সমুদ্রতটে আয়লান কুর্দির নিথর দেহ যেদিন প্রথমবার বিশ্বের চোখে পড়েছিল, তখন যে অন্তর্গত কাঁপন টের পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে ‘শরণার্থী’ পরিচিতি যুক্ত ছিল না। আবার, এ-কথা ধ্রুব সত্য যে, রিফিউজি না হলে, আয়লানের এই পরিণতি হয়তো হত না। গোটা বিশ্ব সেদিন কেঁপেছিল, এক নিরপরাধ শিশুর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। যে-মৃত্যু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন, সীমান্ত সমস্যা, ধর্মভিত্তিক সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বা অন্যান্য বহুতর বিষময় নীতির বহুযুগের ফলাফল। কিন্তু এই পৃথিবীতে স্বল্পদিনের অতিথি আয়লানের সঙ্গে সে-সবের কোনও লেনদেনই তো ছিল না। কিন্তু ঠিক সেই সকল কারণের জন্যই যে-মৃত্যু প্রায় অবধারিত হয়ে নেমে এসেছিল, তা মেনে নেওয়া ছাড়া আয়লানের কাছে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা ছিল না। যে জন্ম তার নিয়ন্ত্রণের অতীত, তাই-ই আয়লানের বেঁচে থাকার অন্তরায়। এ-ট্র্যাজেডি যে ‘ম্যান মেড’, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। ফলে, এর মোকাবিলাতেও আমাদের ফিরতে হবে মানুষ-মোকামেই।

আরও পড়ুন
সোনু সুদের পর, পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে উদ্যোগ নিলেন স্বরা ভাস্করও

আয়লানের মৃত্যু বিশ্বকে বিহ্বল করেছিল ঠিকই। কিন্তু ততটাও কি? ঠিক এর পাশেই তো রাখা যায়, জামলো মাকদমকে। তার বয়সি বাকিরা যখন অনলাইন ক্লাস করছিল, তখন, এই সেদিন, বারো বছরের মেয়েটা, ঘরে ফিরতে চেয়ে, টানা হাঁটার দরুন ক্লান্তি-শ্রান্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কী অবিশ্বাস্য নিয়তি! আয়লান, দেশের সীমানা পেরতে পারেনি। জামলো তার স্বাধীন দেশেই এক রাজ্য থেকে আর-এক রাজ্যে পৌঁছতে পারল না। পৌঁছনোর কেউ ব্যবস্থাও করেনি। আয়রনি এই যে, এ-সব খবর দ্রুত গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ‘কমিউনিকেশন’ এখন এতটাই উন্নত। কিন্তু আজও দেশ কি বিশ্ব, আয়লান ও জামলোকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে না। না ঘর দিতে পারে , না পারে ঘরে ফেরাতে। মাঝখানে এসে দাঁড়ায় অনেক নীতি, জাত্যাভিমান, রাজনৈতিক অভিসন্ধি, রাষ্ট্রীয় পাশার চাল। এসবই আমাদের জানা কথা। এবং, এইসব দৃশ্য ক্রমাগত যে বিশ্বমানবতাকে লাঞ্চিত করছে, তা অস্বীকার করলে, শুধু নিজের চোখে আঙুল চাপা দেওয়া হয় মাত্র। তা সত্ত্বেও অদ্ভুত নির্লিপ্তি বা উদাসীনতা আমাদের গ্রাস করে। এর মূল কারণ, আমরা কখনই ভাবি না যে, আয়লান বা জামলো ‘আমাদের’ কেউ। ‘ওরা’ যে ‘আমরা’ নই, এই ‘অপর’ নির্মাণের সর্বাত্মক অনুশীলনই সমস্ত কাঁটাতারকে সুচালো করে রাখে চিরকাল।   

আরও পড়ুন
বরং পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য অর্থসংগ্রহ হোক, সাহায্যের প্রস্তাব নাকচ বই-ব্যবসায়ী রাকেশের

নিঃসন্দেহেই এ-এক জটিল প্রক্রিয়া; এবং, কখন যে আমরাই এই পরিচয় গ্রহণ-বর্জনের রাজনীতি তথা ‘অপর’ নির্মাণে শামিল হয়ে পড়ি, নিজেরাই টের পাই না। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন identity disregard-কে ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন, ‘it takes the form of ignoring, or neglecting altogether, the influence of any sense of identity with others, on what we value and how we behave’. এর সঙ্গে বিভাজনকামী নীতি এবং কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় মদতেই দোসর হয়,  Singular affiliation, যা কিনা ক্রমে ‘takes the form of assuming that any person pre-eminently belongs, for all practical purposes, to one collectively only- no more and no less.’ কিন্তু তা তো সত্যি নয়। অথচ এই ভ্রমই ক্রমাগত অনুশীলনের ফলে, জামলো কি আয়লান আমাদের কাছে সংবাদ হয়ে আসে এবং তথ্য হয়ে থেকে যায় মাত্র। আমরা তাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারি না। যে-কোনও শরণার্থী সমস্যার গোড়ায় আছে এই অভাব। 

আরও পড়ুন
৫০০ পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য ইফতারের আয়োজন, সম্প্রীতির নজির বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে

আমাদের দেশে, এবং এই রাজ্যেও, সাম্প্রতিক অতীতে যেভাবে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ শব্দবন্ধের প্রয়োগ বেড়েছে তা উদ্বেগের। ইউএন রিফিউজি কনভেনশন মোতাবেক, রিফিউজি, মাইগ্রান্ট, স্টেটলেস প্রত্যেকটি শব্দের আলাদা আলাদা ব্যখ্যা আছে। কারা কোন তালিকাভুক্ত হবেন, তার জন্য লম্বা-চওড়া বৈশিষ্ট্য-তালিকাও আছে। কিন্তু দেশভাগের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে যে-দেশ, সেই দেশ যখন নির্বিচারে অবৈধ অনুপ্রবেশ, বা ধর্মভিত্তিক নাগরিকতার প্রসঙ্গ টানে, তখন অনুমান করা যায়, এই দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক অধিবাসীদের মধ্যে আরও-একদফা ‘অপর’ নির্মাণ সমাধা হয়েছে। ‘অবৈধ’ শব্দটির প্রয়োগের সঙ্গেই অপরাধ যুক্ত হয়ে পড়ে। এবং যে কারণে এই অপরাধের প্রসঙ্গ টেনে আনা, প্রশ্ন ওঠে, সেই অপরাধ কার? উত্তর মেলে না। মজা করে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, র্যা ডক্লিফ সাহেব নাকি সরলরেখা আঁকতেই পারতেন না। নয়তো এভাবে কি কেউ দেশের মানচিত্র কাটাছেঁড়া করে! আবার এও বলা হয় যে, তিনি যে এ-বিষয়ে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না, সেটাই নাকি ছিল তাঁর এই কাজ করার ‘কোয়ালিফিকেশন’। আমাদের নেতারা তা মেনে নিয়েছিলেন, এই তিক্ত সত্য উত্তরকালে আমাদের হজম করতেই হয়। কিন্তু উদ্বেগ তখনই, যখন সেই সত্য জেনেও পুনর্বার প্রহসনের আয়োজন হয়, এবং তা গ্রহণ করতে উৎসুক জনতার অভাব হয় না। 

আরও পড়ুন
পথেই প্রসব পরিযায়ী শ্রমিকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর, জন্মের পরেই মৃত সন্তান

ঠিক এর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়েই, সমস্ত ‘পরিযায়ী’, ‘অভিবাসী’, ‘রিফিউজি’ ইত্যাদি প্রভৃতি শব্দগুলিকে আমাদের তাই মানুষ দিয়ে বদলে ফেলতে হয়। পরিচয়ের রাজনীতি এবং তার জটিলতর নকশা আছে; কিন্তু আমরা যেন এই সহজ ও মূলসত্যটি ভুলে না যাই যে, ‘Identifying with others, in various different ways, can be extremely important for living in a society.’ (Making Sense of Identity, Amartya Sen). এবছর শরণার্থী দিবসের থিম হিসেবে বলা হচ্ছে, ‘every action counts’, যে-কাজ বা পদক্ষেপ কিনা আমাদের একটি ‘ইনক্লুসিভ’ পৃথিবী গড়তে সাহায্য করবে। মানুষ হিসেবে ভাবনার অনুশীলন-ই সেই অ্যাকশনের গোড়ার কথা হওয়া উচিৎ। আয়লানের মৃত্যুর পর, তার হতভাগ্য বাবা, অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে কাতর আবেদন করেছিলেন, দরজা খোলা হোক। আয়লানের মৃত্যুর মতোই সভ্যতালাঞ্ছিত দৃশ্যের জন্ম অব্যাহত। শুধু নিজেদের কাছে প্রশ্ন এই যে, আমাদের ভিতরকার অচলায়তন সরিয়ে দরজাগুলো খুলে দিতে পারব তো?

আরও পড়ুন
কুয়ো থেকে উদ্ধার বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের দেহ, আত্মহত্যার অনুমান

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দেশের মহিলা হকি প্লেয়াররা, জোগাড় করলেন ২০ লক্ষ টাকা

More From Author See More