১২ বছরের ছোট্ট একটি ছেলে খেলতে গিয়েছে স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামার আগেই সসে ফিরেও এসেছে। কিন্তু তখন তার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা গায়ে মার খাওয়ার দাগ। হ্যাঁ, সেই সহপাঠীরাই হঠাৎ আঘাত করে তাকে। কারণ আর কিছুই না, হেইনৎজ নামের ছেলেটি জন্মসূত্রে ইহুদি। হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে স্লাভ রাষ্ট্রগুলিতে এভাবেই শুরু হয়েছিল জাতিদাঙ্গা। হিটলারের বাহিনী যত বেশি করে পূর্বদিকে এগিয়েছে, ততই নিজেদের বাসভূমি হারিয়েছেন অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরির অধিবাসী ইহুদিরা। আর তারই অন্তিম পরিণতি কুখ্যাত হলোকাস্ট। যার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য হিসাবে আমাদের সবার পরিচিত আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রি। ছোট্ট এক বালিকার সেই লেখাকে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করেছেন তাঁরই সৎ বোন এভা স্ক্লস। ব্রিটেনের নাগরিক এভা সম্প্রতি ৯২ বছরে আবারও অস্ট্রিয়ার নাগরিকত্ব স্বীকার করেছেন। মিসেস এভার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রীতিমতো নাগরিক স্তরে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে ইউরোপজুড়ে।
১৯৩৮ সাল থেকে অস্ট্রিয়া সীমান্ত পেরিয়ে হিটলারের বাহিনীর আগ্রাসন শুরু হয়ে যায়। সেইসঙ্গে বদলে যেতে থাকে এতদিনের চেনা জীবন। অস্ট্রিয়া থেকে বিতারিত হয়ে অনেক ইহুদি আশ্রয় নিলেন হল্যান্ড বা স্পেনে। কিন্তু সেইসমস্ত দেশও ক্রমশ জার্মানির আক্রমণের শিকার হয়। এভা তাঁর পরিবারের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমস্টারডামে। নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড দখল করলে ঠিকানা হয় অসউইৎজ কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প। এখানেই আলাপ হয় আনা ফ্রাঙ্কের সঙ্গে। প্রায় সমবয়সী দুই বালিকার বন্ধুত্ব জমে ওঠে কিছুদিনের মধ্যেই। আনা ফ্র্যাঙ্ক কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পায়নি। মুক্তি পাননি এভার বাবা এবং ভাইও। ১৯৪৫ সালে রেড আর্মি যখন অসউইৎজ ক্যাম্প দখল করে, তখন এভা এবং তাঁর মা জীবিত। আমস্টারডামে কিছুদিন থাকার পর তাঁরা আশ্রয় নেন লন্ডনে। এই সময় আনা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্ককে বিবাহ করেন এভার মা এলফ্রিড।
লন্ডন থেকেই হলোকাস্টের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যান এভা। তৈরি করেছেন আনা ফ্রাঙ্ক সোসাইটিও। তবে কোনোদিন অস্ট্রিয়ায় ফিরে যাননি আর। ব্রিটেনেই স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এভা। ৭০ বছর ধরে এই দেশের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে জীবন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কি তাহলে দেশে ফিরতে চাইছেন এভা স্ক্লস? তিনি নিজে অবশ্য জানিয়েছেন, এক মুহূর্তের জন্যও অস্ট্রিয়ায় ফেরা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে ঘুরতে যাওয়া যায়, কিন্তু স্থায়ী বসবাস অসম্ভব। তাঁর ছেলেবেলার চেনা সেই দেশটা আর নেই। কিন্তু এই ৭০ বছর ধরে যে ক্রমশ জার্মান-ইহুদি বিরোধের মীমাংসা সম্ভব হয়েছে, তাও তো ইতিহাসেরই অংশ। দাঙ্গাও যেমন সত্যি, এই ভ্রাতৃত্বও সত্যি। আর সেই ইতিহাসের প্রতীক হিসাবেই তিনি অস্ট্রিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। আর সেই অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে লন্ডন শহরেই। এবার ইংল্যান্ডের পাশাপাশি অস্ট্রিয়ারও নাগরিক এভা স্ক্লস। তাঁর মতে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সবরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই এখন সময়ের দাবি। এই গোটা পৃথিবীটাই তো আমাদের দেশ।
Powered by Froala Editor