ফটোগ্রাফির আদিযুগ ও বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফারের কাহিনি

উনিশ শতকের শুরুর দশকগুলিতে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসাবে নেওয়ার স্পর্ধা ছিল না অনেকেরই। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা একপ্রকার বাধ্য হয়েই চলতেন জল মেপে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) অনুসারে, এই মুহূর্তে ভারতে লিঙ্গ বেতনের ব্যবধান ২৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের চিত্রটা যদি এমন হয়, তাহলে তখন ভারতীয় মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থানের কার্যকারিতা কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

ওই সময় কিছু মহিলা তাঁদের কাজের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার স্পর্ধা দেখান। তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে নিজস্ব পরিচয়ে রঙিন। তাঁদের ইতিহাস লেখা অন্য শৈলীতে। তেমনই একজন ব্যতিক্রমী নারী অন্নপূর্ণা দত্ত। তখন পুরুষদের মধ্যেই স্টুডিয়ো ফটোগ্রাফি সীমাবদ্ধ। অমন সামাজিক অবস্থার সমান্তরালেই কিন্তু অন্নপূর্ণা দত্তের ফটোগ্রাফি। 

অন্নপূর্ণা দত্তের জন্ম ১৮৯৪ সালে অবিভক্ত বাংলায়। পেশাদার মহিলা ফটোগ্রাফারদের অন্যতম তিনি। ১৯২০-র দশকে, একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে অন্নপূর্ণা দত্তের প্রতিভা সামনে আসে। এমন একটি সময়ে তাঁর এই ভূমিকা, যখন মহিলারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করবে এমন ভাবনা পরিচিত ধাঁচের বাইরে। ধাঁচা ভাঙা এক নারী অন্নপূর্ণা দত্ত। তিনি তৎকালীন ধনী ভারতীয় পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তোলেন সেখানকার মানুষের অন্তরঙ্গ প্রতিকৃতি। সেসব আলোকচিত্রে গার্হস্থ্য জীবনের সারমর্ম প্রতিফলিত। স্ব-উদ্যোগেই এই ফটোগ্রাফগুলি মুদ্রিত। করেছিলেন মুসলিম অভিজাতদের পরিবারে চিত্র গ্রহণের কাজও। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হাসান সোহরাওয়ার্দী, কবি জসিমউদ্দীন এবং প্রখ্যাত গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহমেদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ছবি তোলেন। ক্যামেরাবন্দি করেন হিজাব পরিহিত মুসলিম মহিলাদের ছবি। মহিলাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতি ফটোগ্রাফির আগে নয়, বরং তাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে তাঁদের যাপনের অঙ্গ হিসাবে, এমনই বিশ্বাসে বিশ্বাসী অন্নপূর্ণা দত্ত। সেকারণেই জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে আলোকচিত্র গ্রহণের কাজ করতে পেরেছিলেন।

প্রাণীবিজ্ঞানী ফটোগ্রাফার জন জর্জের কন্যা ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী আনা অ্যাটকিনসের ক্যামেরা হাতে দক্ষতার কথা অনেকেরই জানা। অনেক ব্রিটিশ মহিলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু মুহূর্তই রেকর্ড রাখতেন। সেসব তাঁদের জীবন ও ইতিহাসের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। অলিভ এডিস হলেন প্রথম মহিলা, যাঁকে ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে ছবি তুলতেন ক্রিস্টিনা ব্রুম। নিজেকে ‘প্রেস ফটোগ্রাফার’ বলে ডাকতেন। ১৮৬৮ সালে সেকেন্দ্রাবাদে লালা দীনদয়াল তাঁর স্টুডিয়ো ‘লালা দীনদয়াল অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯২ সালে লালা দীনদয়ালেরই উদ্যোগে চালু জেনানা স্টুডিয়ো। ওই সময় কিছু ভারতীয় মহিলা শিক্ষক, নার্স, ডাক্তার হিসাবে পেশায় আসতে শুরু করছিলেন। কিন্তু ক্যামেরায় ছবি তোলাকে লোকজন মূলত টাইম পাস হিসাবেই দেখত। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে ফটোগ্রাফি শিল্পকে আয়ত্ত করেছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের স্ত্রী মহারানি মনমোহিনী। ঠাকুর পরিবারের জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহের কথা বহুল চর্চিত। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে প্রথম ফটোগ্রাফার নিয়ে এসে হইচই ফেলা মহিলা জ্ঞানদানন্দিনীই। কলকাতার সুপরিচিত ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিয়ো’-তে ফটোগ্রাফির শিক্ষা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের অন্যতম মহিলা সদস্য মিসেস ই. মেয়ার ভারতের প্রথম পেশাদার ফোটোগ্রাফার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। প্রথম বাঙালি ফটোগ্রাফার সরোজিনী ঘোষ কলকাতার ৩২, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ‘দ্য মহিলা আর্ট স্টুডিয়ো’ নামে তাঁর নিজস্ব স্টুডিয়ো এবং ফটোগ্রাফিক স্টোর খোলেন। সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘ছোবি তোলা’য় লিখেছেন, ‘তিনি তাঁর দেশের পুরুষদের হাতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার যোগ্য ছিলেন।’ ১৯২০ সাল থেকে বাঙালিরাও গুরুত্ব সহকারে ছবি তোলা শুরু করে। যদিও তাঁদের কেউই পেশাদার ছিলেন না। এই ভূমিকাটি প্রথম নেন অন্নপূর্ণা দত্ত। কলকাতায় তাঁর বাড়ি থেকে একটি ব্যবসা চালাতেন। ফটোগ্রাফি থেকে প্রাপ্ত উপার্জন তাঁর পরিবারকেও সাহায্য করত।

আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ফটোগ্রাফিক স্টুডিও কলকাতাতেই; ১৫৩ বছরের যাত্রায় দাঁড়ি টেনেছিল অর্থাভাব

অন্নপূর্ণা দত্তের সবচেয়ে আইকনিক চিত্রগুলির মধ্যে একটি স্ব-প্রতিকৃতি, যা তাঁর প্লেট ক্যামেরার পাশে তিন-চতুর্থাংশ প্রোফাইলে বন্দি করা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লেন্সের ক্যাপ ধরে আছেন তিনি। তাঁর লাবণ্যময়ী দৃষ্টি ফ্রেমের বাইরের দিকে। চোখমুখে আত্মবিশ্বাস। নিজের বাড়ির স্টুডিয়োতে নিজেই এই ছবি তুলে তা মুদ্রণও করেন তিনি। অন্নপূর্ণা দত্তের তোলা প্রতিকৃতিগুলি গার্হস্থের বিষয়গুলিকে তুলে ধরে। স্ব-প্রতিকৃতি বুঝিয়ে দেয়, বেশ বনেদি তাঁদের পরিবার। অন্নপূর্ণা দত্তের পোশাক ঠারেঠোরে ‘ঐতিহ্য’কেই সমর্থন করে। ছবিটি বর্তমানে তাঁর ছেলে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রহের অংশ। এহেন ছবিওয়ালি তরুণ-তরুণীর কাছে আদরের ‘ফটোগ্রাফার মাসিমা’। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১২, বিয়ে হয় আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। তাঁর স্বামীরও পছন্দের বিষয় ফটোগ্রাফি। অন্নপূর্ণার প্রেরণার বীজ তিনিই। ১৯৩০-৪০ দশকে একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু অন্নপূর্ণা দত্তের। ফটোগ্রাফির ইতিহাসে চির উজ্জ্বল তাঁর নাম। ক্যামেরা হাতে নেওয়া অন্নপূর্ণা দত্তের সেই স্ব-প্রতিকৃতি ‘স্বাধীনচেতা নারী’র একটি আইকনিক চিত্রও।

আরও পড়ুন
হুইলচেয়ারে বসেই ফটোগ্রাফি, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রতিবন্ধকতা জয় খড়গপুরের শুভ্র-র

Powered by Froala Editor

Latest News See More