১৯৪৫ সালের মার্চ মাস, শেষ হয় আনা ফ্রাঙ্কের (Anna Frank) ডায়রির পাতা। এর আগে ২ বছর ধরে নাৎসিদের (Nazi) হাত থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করে ছিলেন এই ইহুদি কিশোরী (Jews Girl) এবং তাঁর পরিবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান তাঁরা। এও জানা যায়, তাঁদের ঠিকানা জানতেন এমন কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের। কিছুদিন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটানোর পর মৃত্যু হয় আনার। আর এই পুরো সময়ের দলিল তিনি ধরে রেখেছিলেন তাঁর ডায়রিতে। ১৫ বছরের কিশোরী আনার ডায়রি এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ইহুদি নির্যাতনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং প্রচারিত দলিল। ২০০৯ সালে তা জাতিপুঞ্জের ‘মেমোরি অফ ওয়ার্ল্ড’ তালিকাভুক্তও হয়। কিন্তু এর মধ্যেই থেকে গিয়েছিল একটি রহস্য। কে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আনা এবং তাঁর পরিবারকে?
বিশ্বযুদ্ধের ৭৭ বছর পর অবশেষে উঠে এল সেই তথ্য। ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল বিবিএসের অনুষ্ঠান ‘সিক্সটি মিনিটস’-এ এমনটাই জানিয়েছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর আধিকারিক ভিন্স প্যানকোকে। তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দফায় দফায় এই বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে গিয়েছে এফবিআই-এর বিভিন্ন দল। আর গোয়েন্দাদের সঙ্গে এই তদন্তে যুক্ত থেকেছেন ইতিহাসবিদরাও। শেষ পর্যন্ত নানা তথ্য জড়ো করা হয়। কিন্তু সেই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগান তাঁরা। আর এভাবেই উঠে আসে আরনল্ড ভ্যান ডেনবার্গ নামে এক ব্যক্তির পরিচয়। তিনিও ইহুদি ছিলেন। আমস্টারডাম শহরের ইহুদি কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের মধ্যে নাৎসি আদর্শ প্রচার করাই ছিল এই কাউন্সিলের কাজ। আনা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্কও ছিলেন এই কাউন্সিলের সদস্য। অনেকেই মনেপ্রাণে নাৎসি আদর্শে বিশ্বাস করেছিলেন। আবার অনেকে নিছক আত্মরক্ষার জন্যই এই কাউন্সিলের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। তবে ১৯৪৩ সালে এই কাউন্সিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর সদস্যদেরও আত্মগোপন করতে হয় তখনই। এফবিআই-এর তদন্ত রিপোর্ট বলছে, কাউন্সিলের সমস্ত সদস্যই হয় আত্মগোপনকালেই মারা গিয়েছেন অথবা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি হয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ডেনবার্গ। তিনি যুদ্ধের সময় এবং তার পরেও বহাল তবিয়তে থেকে যান আমস্টারডাম শহরে।
শুধু আনা ফ্রাঙ্কের পরিবারই নয়, আরও অনেক ইহুদিকেই ডেনবার্গ ধরিয়ে দিয়েছিলেন বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। অবশ্য প্যানকোকের মতে, তিনি এই কাজ করেছিলেন আত্মরক্ষার জন্যই। এমনকি তদন্তকারীরা সন্দেহ করছেন, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে থাকার সময় অটো ফ্রাঙ্ক জানতেও পেরেছিলেন বিশ্বাসঘাতকের পরিচয়। তাঁর কাছে একটি বেনামি চিরকুট এসেছিল, যাতে লেখা ছিল শুধু ডেনবার্গের নাম। তবে কাউকেই তিনি এই কথা জানতে দেননি। অনেক পরে সেই চিরকুট উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা।
আরও পড়ুন
জার্মান শেফার্ডের কবিতাপাঠ! নাৎসি গবেষকদের দৌলতে কুকুরও হয়ে উঠেছিল বাঙ্ময়
এফবিআই-এর এই তদন্তের প্রশংসা জানিয়েছেন আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়ামের আধিকারিকরাও। তাঁরা যদিও এই তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তদন্তকারী দলটি তাঁদের হাতে নানা তথ্য তুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তবে ঐতিহাসিকদের একাংশ এখনও এই মত মানতে রাজি নন। গণহত্যা বিষয়ক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ জোনস হাউইং কেট এবং আরও অনেকের মতে, এত বছর পর কাউকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে প্রমাণ করতে গেলে যে পরিমাণ তথ্যের প্রয়োজন তা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কোনো অপ্রকাশিত তথ্য যদি এফবিআই-এর কাছে থেকে থাকে তাহলে তা সামনে আনার কথাও জানিয়েছেন তাঁরা। কেটের মতে, আনা ফ্রাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় জানা ইতিহাসের জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু তা যেন আরেকটা ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বে পরিণত না হয়।
আরও পড়ুন
পেশা নাৎসি-শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাস্তব ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’