ভরসা হুইলচেয়ার, ঘুরে দাঁড়াতে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে কলকাতার অঙ্কুর

আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিকই ছিল অঙ্কুরের জীবন-যাপন। কলকাতার অঙ্কুর দাস। সুস্থভাবে স্কুলে যাওয়া, খেলা, সমস্ত কিছুই ছিল স্বাভাবিক। তবে অপেক্ষা করছিল এক অন্য ঝড়। অঙ্কুরের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন থেকেই ধীরে ধীরে বাঁকতে শুরু করে তার পিঠ। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল, ডরসাল স্পাইন স্কোলিওসিস। প্রতি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে একজনের হয় এই রোগ। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই একজনের দলে পড়ে যায় অঙ্কুর। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ২০১২-এর ২৩ মার্চ, ভেলোরে অঙ্কুরের প্রথম অপারেশন হয়। শিরদাঁড়ার ওপরের যে অংশটি বেঁকে গিয়েছিল, সেখানে বসে দুটো টাইটেনিয়ামের পাত। পিঠ তো ঠিক হল সামান্য, কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। অঙ্কুরের বুকের নীচ থেকে শরীরের বাকি অংশ পুরোপুরি অসাড় হয়ে যায়। সাল ২০১৬। ডাক্তাররা অঙ্কুরের বাবা, দেবাশিস দাস’কে জানান, আর কোনওদিন সুস্থভাবে হাঁটাচলা করতে পারবে না অঙ্কুর। সারাজীবন হুইলচেয়ারেই কাটাতে হবে তাকে।

গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আসল ব্যাপার ঘটল এর পরে। যে ছটফটে অঙ্কুর এক সময় দুদ্দাড় করে খেলত, সে বন্দি হয়ে পড়ল হুইলচেয়ারে। রিহ্যাব থেকে বলা হল, আবার কোনও খেলায় অঙ্কুরকে যুক্ত করতে। খেলা হিসেবে বেছে নেওয়া হল রাইফেল শ্যুটিং। অতঃপর, শুরু হল শুটার অঙ্কুর দাসের গল্প। যে গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে লড়াই, সাফল্য, ছড়িয়ে আছে হতাশাও।

অলিম্পিয়ান জয়দীপ কর্মকারের অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয় অঙ্কুর। কয়েক মাসেই তার দক্ষতা নজরে আসতে থাকে বাকিদের। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, জিম, অনুশীলন— সমস্ত কিছু চলতে থাকে একসঙ্গে।

প্রসঙ্গত, প্যারা শুটিংয়ে মূলত দুটি বিভাগ থাকে। একটি হল এসএইচ-১ এবং অন্যটি এসএইচ-২। যে সমস্ত প্যারা শুটারদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ৭০%-এর বেশি, তাঁরা এসএইচ-২য়ের মধ্যে পড়বেন। বাকিরা এসএইচ-১ বিভাগে। এই নিয়ম অনুযায়ী, অঙ্কুর এসএইচ-২ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এত অসুবিধা নিয়েও লড়াই থামেনি তার। আর এই কঠোর পরিশ্রমেরই ফল সে পায় প্রথম জাতীয় প্যারা শ্যুটিং মিটে। প্রথম মিটেই সোনা যেতে অঙ্কুর। তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর।

এখানেই থেমে থাকেনি তার মেডেল জয়। জাতীয় শ্যুটিং-এ ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দুটি সোনা এবং ১০ মিটার প্রোনে দুটি সোনা জিতেছে বেহালার জিবি মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটের এই ছাত্র। ন্যাশনাল প্যারা শুটিং রেকর্ডও তার দখলে। সম্প্রতি দিল্লিতে জাতীয় স্তরে কুমার সুরেন্দ্র সিং মেমোরিয়াল শুটিংয়ে দুটি সোনা এবং একটি রুপো জেতে অঙ্কুর। শারীরিক কোনও প্রতিবন্ধকতাই তাকে টলাতে পারেনি। কিন্তু দেখা দিয়েছিল অন্য সমস্যা।

নিয়ম অনুযায়ী, অঙ্কুর প্যারা শুটিংয়ের এসএইচ-২ ক্যাটাগরির শুটার। কিন্তু, এই ক্যাটাগরির শুটিং আয়োজন করতে যে পরিকাঠামো দরকার, সেই পরিকাঠামো এখন ভারতে নেই। সেইরকম প্রতিযোগিতাও হয় না এই ক্যাটাগরির। যার জন্য, প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে এবং ঝুঁকি নিয়ে অঙ্কুরকে এসএইচ-১ ক্যাটাগরিতে খেলতে হয়। মনে রাখতে হবে, এই বিভাগে যারা খেলছে, তাদের প্রতিবন্ধকতা অঙ্কুরের মতো প্রতিযোগীদের থেকে অনেক কম। এই গেল সমস্যার একদিক। আরও এক সমস্যা দেখা দিয়েছিল নতুন করে। পৃথিবীর সমস্ত প্যারা প্রতিযোগিতাগুলো পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল প্যারালিম্পিক কমিটি, বা আইপিসি। তাদের সঙ্গে পরিকাঠামোগত এবং অন্যান্য ব্যাপারে ভারতের ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের মতবিরোধের দরুন, ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে আইপিসি’র প্রতিযোগিতা উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর আইপিসি হাত সরিয়ে নেওয়ার জন্য, বিপদে পড়তে বসেছিল অঙ্কুরের মতো প্রতিভাবান শ্যুটাররা। যাদের জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাগুলিতে সুযোগ পাওয়ার উপায় অনিশ্চিত হতে বসে। আশার বিষয়, সম্প্রতি এনআরএআই সার্কুলার থেকে জানা গেছে, জাতীয় স্তরে খেলতে পারবেন অঙ্কুর। গতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অঙ্কুর দাস, এই বছরও কী ম্যাজিক করেন তার দিকেই চেয়ে আছেন দর্শকেরা।

More From Author See More