পড়শির দুরকম জানলা। একধরনের জানলা দিয়ে হিংসে ঢোকে। ঢোকে সিরিয়ালের দুষ্টু মেয়ে। অনিডা টিভির ভূত। সাদা কালো ব’লে গত জন্মের স্মৃতি ভেবে উড়িয়ে দেয় মানুষ। আর অন্য জানলায় ঢোকে সাড়ে চুয়াত্তর। ওরা থাকে ওধারে। ভানু ব্যানারজির মালপো। অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউসের লোকগুলো এক এক ক’রে নেমে আসে। আমি শুধু এই দুই এর মাঝের দরজাটায় দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। ভেতরে আসার অনুমতি চাইলে বড়কত্তা বলেছে ‘দাঁড়া, তোর কাকিমার পড়া হল কিনা’, আর হারেম থেকে মহিলা কণ্ঠ বলেছে ‘পরে আসিস’। আর তদ্দিনে আদুরে গালটা রাজনীতির দেয়ালে ঘষটানি খেয়ে আরও অনেক শক্ত হয়েছে। ‘ওমা, এত্ত বড় হয়ে গেছিস’ পালটে গিয়ে হয়েছে, ‘কি রে, বাবা কাগজ কিনে দেয় না’। আমি আমার ইনসিকিওরিটি খেতে খেতে বড় হয়ে যাই একদিন।
পড়শি ভালোও হয়। ঠাম্মা বলত। খিলাড়ির শক্তি কাপুর। কিংবা প্রেম চোপড়া। শহিদের। পরে বুঝলাম একটা বয়সের পর ঠাম্মারাই পড়শি হয়ে যায়। আর তখন পড়শি মানে সন্ধের রক, তুলসী তলা নয়, একটা বয়সের পর আসলে যেখান থেকে সন্ধে দিতে হয় ওই পড়শিদের। পড়শি মানে সদর দরজা পেরিয়ে সব বাড়ির গেরস্থের খোকা হোক। খোকা হয়। ‘ওমা, একদম মায়ের মতো’, ‘কি নাম রেখেছিস’, ‘দেখো আবার, আমারটা না...’ পেরিয়ে খোকা বড় হয়। বোঝে না, পারস্পরিক দেয়ালের চাপ ছাড়াই এখানে ওখানে গজিয়ে ওঠে আরও অজস্র দেয়াল, পড়শির বেড়ালটা বাচ্চা দিচ্ছে, মরে যাচ্ছে অগোচরে। বারোয়ারি অশ্বত্থ গাছটা ডালপালা মেলে মাটির দিকে তাকিয়ে, পাছে কেউ এক গোছা দড়ি নিয়ে বলবে, কই গো সেজো গিন্নি, দরজা খোলো। বেনোজলে একসময় ভেসে যায় বুড়ি চাঁদটা। সেই গাছটা আর থাকে না। তবে পড়শিরা থাকে। শুধু মুখগুলোই যা আর চিনতে পারি না।
মনে হয় বড়সড় একটা আরশি টাঙ্গানো থাকত ছোটবেলার পাড়াগুলোতে। আর টেরাবেঁকা সেইসব প্রতিচ্ছবিদের সাথেই সন্ধেয় গল্প করতে যেত আমাদের ফিকশনাল মা-মাসীরা। আমারই কোনও এক অবাধ্য রাতে কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষরে সেদিন ঝুলে পড়েছিল মোড়ের মাথার বাড়িটার উসকো খুসকো ব্রিলিয়াণ্ট ছেলেটা। ঔরসের অহঙ্কারে যেদিন ওকে একটার পর একটা চুম্বন করেছিলাম অনেক দিন পর, তার পরের দিনের ভীষণ ব্যস্ত আমিটাই কি এবাড়ি ওবাড়ি মিষ্টির হাঁড়ি পৌঁছে দেওয়া গর্বিত যুবক না? ‘ওকে ছাড়া বাঁচব না’ ব’লে পাড়ার খিস্তি শোনা স্মার্ট রেব্যান কিশোর আসলে কি সেই আমিটাই না, যে যুদ্ধ ফেরত কোনও এক রীনা ব্রাউনের গলায় দরবাড়ি কানাড়া শুনবে ব’লে রাতের পর রাত টেলিফোনটাকে ব্যস্ত রেখেছিল মহীনের ঘোড়াদের মতো। একসময় নিটোল আমেরিকান ভঙ্গিতে জেমস স্টুয়ার্টের মতো লেন্স তুলে নিই হাতে। কে বলতে পারে, আজ রাত্রেই একটি হত্যা দৃশ্য দেখতে হবে না আমায়?
এভাবে ভয় আর ভয়্যারের কাঁধে যেতে যেতে একদিন ঠিক ওপারে পৌঁছে যায় আমাদের পড়শিকথন। খইয়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে একদিন বাড়ি ফেরে পড়শির বেড়ালটা। উত্তর কলকাতার সন্ধেগুলো ধারে ভারে আর টিকতে পারে না যার-যার-তার-তার নোনা জলের আইল্যান্ডগুলোর সঙ্গে। রাস্তা কোথায় জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে, ‘দেখছ না, আমরাও খুঁজছি’। এ যেন তথাগতর বাড়ি বাড়ি ঢুকে সুখ না পাওয়ার গল্পের মতো। ভুলে যাই, আমি নিজেও তো পড়শির পড়শি। আমি নিজেও তো ও বাড়ির ছেলে হলে গায়ে রক্তবীজ বুনি। ক্যালেন্ডার থেকে বাচ্চাদের ধরে এনে শোয়াই দুজনের পাশে। সকাল হয়। বীভৎস ঝগড়ায় ঘুম ভাঙ্গে পাঁচিলের ওপাশে থাকা পড়শির। ‘সমস্যা হলে অল্পেই মিটিয়ে নাও না, কেন পাড়া পড়শি করো বাপু’, এপাশের পড়শি বলে ‘আচ্ছা’। আমি দর্শক মাত্র। জানি না, আমি আসলে কোথায় আছি, পাঁচিলের এপাশে না ওপাশে ।