২০১৪ বিশ্বকাপ। প্রথম থেকেই ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা ছিল বিশ্বকাপের অন্যতম দুই দাবিদার। দুই ল্যাটিন আমেরিকান দেশেরই বিজয়রথ শেষমেশ ধরাশায়ী হয়েছিল জার্মানির কাছে। ব্রাজিল হার মেনেছিল ৭-১ গোলে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ফাইনালে তুল্যমূল্য স্বপ্নের ফুটবল ম্যাচ। এই দুই জয়ের পিছনেই ছিল তাঁর অনস্বীকার্য কৃতিত্ব। আন্দ্রে শার্লা। ২০১৪-র সেই বিশ্বকাপজয়ী জার্মান ফুটবলার মাত্র ২৯ বছর বয়সেই থেমে গেলেন। অবসর নিলেন ফুটবলে জগত থেকে।
সেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে জোড়া গোল ছিল তাঁর। ফাইনাল জয়ের নেপথ্যেও তিনি। এক-দুই-তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে লেফট ফ্ল্যাঙ্কে একটা স্বপ্নের দৌড়। তার পর ক্রস। মারিও গোটজে চেস্টট্র্যাপে নামিয়ে আনলেন সেই বল। রোমেরোকে বোকা বানাতে সময় লাগেনি। ৯০ মিনিটের পরে এক্সট্রা টাইমে জয়ের ডঙ্কা বেজেছিল অন্তিম মুহূর্তে। বাকিটা ইতিহাস। অনেকের স্বপ্নভঙ্গ, অনেকের উল্লাস। আর তাতেই মিশে ছিল আন্দ্রে শার্লার নাম।
কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বিশ্বকাপের ফাইনাল ও সেমি-ফাইনাল দুই ম্যাচেরই প্রথম একাদশে ছিলেন না তিনি। নেমেছিলেন পরিবর্ত হিসাবে। ছিলেন জোয়াকিম লো’র আস্তিনে লুকানো তাস। ছিলেন দুরন্ত গতি, হিল ফ্লিক আর লং রানের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে প্রতিপক্ষে কড়া আঘাত হানার প্রধান অস্ত্র। সেই ট্রেন্ডই কি পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হতে থাকল তাঁর কেরিয়ারে?
সাফল্য-ব্যর্থতা তো যে-কোনো ফুটবলারেই সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে। তাঁর সঙ্গেও ছিল। কিন্তু শেষ কয়েকটি সিজনে রেকর্ড যে খুব ভালো ছিল, তাও নয়। শেষ পাঁচটি সিজনে ক্লাব কেরিয়ারে মাত্র ২০টি গোল। যদিও উইঙ্গার হওয়ায় গোলের সংখ্যা কম হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কতটা সুযোগ পেয়েছেন শার্লা? সেই প্রশ্নও ঘুরে ফিরে আসে।
২০০৯ সালে মেইঞ্জে শুরু করেছিলেন ফুটবল ক্যারিয়ার। ২০১১-তে বায়ার লেভারকুশেন। ২০১৩-তে চেলসি। এই সময়টায় বিপক্ষের ত্রাস ছিলেন আন্দ্রে শার্লা। তার মধ্যেই ২০১৪-র বিশ্বকাপে অবিস্মরণীয় পারফর্মেন্স। তা সত্ত্বেও গোলের অভাব আর ছন্দপতনের কারণে চেলসি ছাড়তে হল ২০১৫-তে। সেই সময় নিজের সেরা ফর্মেই ছিলেন শার্লা। একাধিক সাংবাদিক সম্মেলনে চেলসিকে 'পরিবার' আখ্যাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই দল থেকে তাঁর নাম কাটালেন হোসে মোরিনহো। শার্লা গেলেন উলফবার্গে। সেখানেও ফর্ম যে খুব একটা খারাপ ছিল, তাও নয়। চ্যাম্পিয়ান্স লিগে কোয়ার্টার ফাইনালে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন রিয়ালকেও। প্রথম লেগে ২-০ এর লিড রাখার পিছনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। পরের বছর আবার ক্লাব বদল। গেলেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। কিন্তু সেই পরিবর্তের তালিকাতেই রয়ে গেলেন সেখানে। মাঠে মুক্ত ঝরানোর সুযোগটাই এল না। রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতেই ফর্ম হারালেন শার্লা।
ডর্টমুন্ডের সঙ্গে ২০১৬ থেকে ৫ বছরের চুক্তি থাকলেও, এর মাঝে লোনে খেলতে হয়েছে ফুলহ্যাম আর স্পার্টাক মস্কোতে। কিন্তু এই সিজন শেষ হতে না হতেই চুক্তি ভাঙল সেই ডর্টমুন্ডই। ক্ষতিপূরণ দিয়ে ক্লাবের তালিকা থেকে সরিয়ে দিল তাঁর নাম। মাঝখান থেকে মাঠে নামার খিদে আর অপেক্ষায় শেষ হয়ে গেল শার্লার ফুটবল দুনিয়া। একজন যথেষ্ট প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের মনোবল আর আত্মবিশ্বাসের কাছে এই বসে থাকাটাই সব থেকে বড়ো অভিশাপ। শেষ চার বছরে মাত্র ৭০টি ম্যাচ। তাও অর্ধেকের বেশি ম্যাচে নামার সুযোগ হয়েছে হাফটাইমের পর। এর সমান্তরালেই চোট। চোটের কারণে একশো শতাংশ ফিটনেস না থাকাও অনেকখানিই দায়ী তাঁর এই ছন্দপতনের পিছনে। এ যেন ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস!
আরও পড়ুন
তাস খেলেই দেশে এনেছেন স্বর্ণপদক, এবার অর্জুন পুরস্কারের দৌড়ে দুই বাঙালি
নিজের ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ব্রাজিলিয়ান তারকা কাকার মতই রিজার্ভ বেঞ্চের শিকার হলেন শার্লা। এই ফুরিয়ে যাওয়ার পিছনে প্রবাদপ্রতিম ফুটবল ক্লাবগুলিরও দায় নেই কি? ক্লাবগুলির এই মানসিকতার প্রতি খানিকটা অভিমান নিয়েই বিদায় জানালেন শার্লা। অবসর ঘোষণার দিন সেই কথাই ফিরে এসেছিল বার বার তাঁর মুখে। নিজেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই রিজার্ভ বেঞ্চ, একের পর এক ম্যাচে গোলের খরা বেশ হতাশার দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল তাঁকে। “ভালো সময় ফুরিয়ে আসছিল হয়তো। প্রয়োজন ফুরিয়েছে আমার। তাই অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত। বাণিজ্যিক ফুটবলের দুনিয়ায় টিকে থাকতে গেলে ফর্মকে হতে হয় সবসময়ের সঙ্গী। নইলেই জায়গা হারাতে হয় নিজের পজিশন থেকে।”
দশ বছরের ছোট্ট ক্যারিয়ার। তার মধ্যেই সংগ্রহ ৮৬টি ক্লাব গোল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৫৭ ম্যাচে ২২টি গোল। রয়েছে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা, দুটি ডিএফবি পোকাল এবং সর্বোপরি বিশ্বকাপ। ফুরিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তেও নিজের জাত চিনিয়েছিলেন শার্লা। ২০১৯। প্রিমিয়ার লিগে ফুলহ্যামে লোনে খেলতে যাওয়া। বার্নলির ম্যাচে ঝলসে উঠল তাঁর ডান পা। পিছন থেকে ভেসে আসা বলকে অ্যাঙ্কেলে নামানো। তারপর ৩০ গজের দূরত্ব থেকে নিখুঁত লব করে লক্ষ্যভেদ দ্বিতীয় পোস্টের কানা ঘেঁষে। সেই মাসে লিগের সেরা গোলের সম্মান মিলেছিল শার্লার।
এসবের পরেও অসময়ে বুট তুলে রাখা। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থাকার সময়ই মাঠ ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সবুজ ঘাসে তাঁকে আর দেখা যাবে না। সেই শূন্যস্থান পূরণও করবে নতুন কোনো খেলোয়াড়। কিন্তু ফুটবলে তাঁর সোনার ছোঁয়াগুলোই থেকে যাবে বছরের পর বছর। আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সারথীদের মধ্যে উচ্চারিত হবে তাঁর নাম। এই অফ-ফর্ম, গোলখরাই কি একজন প্লেয়ারকে ডিফাইন করে? মনে হয় না। কারণ শার্লার টাচ, ক্রস, রিসিভ, পিনপয়েন্ট থ্রু, টার্নিং, রান মুগ্ধ করেছে বহুমানুষকে। ঘুম কেড়েছে বিপক্ষের সমর্থকদের। বহু বহু ফুটবল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে এসেছে। সেখানেই তাঁর সাফল্য। সেখানেই তাঁর চূড়ান্ত জিতে যাওয়া। এই অবসর শুধু আধুনিক ফুটবলের নয়, বরং সমগ্র ফুটবলপ্রেমীদের কাছে একটা বড় ক্ষতি...
আরও পড়ুন
করোনার জেরে চার বছর পিছোল যুব অলিম্পিক
Powered by Froala Editor