দু’ধারে ধানক্ষেত। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘর-বাড়ি ছড়িয়ে রয়েছে মাঝেমধ্যে। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মাটির রাস্তা। আর তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বাস। তাকে কেন্দ্র করেই অসংখ্য মানুষের জটলা। ব্যাপার কী? কাছে গেলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা। আসলে এই বাস কোনো যাত্রীবাহী যান নয়। বরং, আস্ত একটি চিকিৎসাকেন্দ্র।
অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোর সংলগ্ন প্রান্তিক অঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে এই দৃশ্যের। আর এই ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্রের নেপথ্যে রয়েছেন নেল্লোরের খ্যাতনামা নিউরোলজিস্ট ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডাঃ বিন্দু মেনন (Dr. Bindu Menon)। বিগত ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই প্রান্তিক অঞ্চলে বিনামূল্যে দরিদ্র মানুষদের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি।
মূলত নেল্লোরই তাঁর কর্মক্ষেত্র হলেও, ডাঃ মেননের জন্ম আসলে তিরুপতিতে। তিরুপতি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পড়াশোনা করার পর নেল্লোরে চলে আসেন তিনি। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক হিসাবেই তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন অ্যাপোলো মেডিক্যাল হসপিটালে। পরে হয়ে ওঠেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তবে রোগীদের চিকিৎসা করার কাজও বন্ধ করেননি তিনি। একুশ শতকের শুরুর দিকেই অন্ধ্রপ্রদেশের চিকিৎসক মহলের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন এই তরুণী নিউরোলজিস্ট।
তবে প্রাতিষ্ঠানিকতা ছেড়ে, ময়দানে নামা তারও অনেক পরে। ২০০৮ সালের কথা। প্রথমবার সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েই এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হন তিনি। তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এমনকি অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরাও। না, এই ঘটনা খুব একটা অবাক করেনি তাঁকে। বরং, অবাক করেছিল তাঁদের করা প্রশ্ন। ডাঃ মেনন বুঝতে পারেন স্নায়বিক রোগ সম্পর্কে এতটুকুও সচেতন নন সাধারণ মানুষ। একদিকে যেমন এই রোগকে ততটাও গুরুত্ব দেন না অনেকে। তেমনই কুষ্ঠ কিংবা মৃগীর মতো রোগের সম্পর্কেও বহু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে অধিকাংশ মানুষেরই। যা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে।
সমাধান হিসাবে, নেল্লোর ও অন্ধ্রপ্রদেশের অন্যান্য শহরগুলিতে জনসচেতনতা তৈরিতে বিশেষ প্রচার চালু করেন ডাঃ মেনন। সঙ্গে পেয়েছিলেন তাঁর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং সতীর্থ চিকিৎসকদেরও।
প্রাথমিকভাবে মূলত শহর ও শহরতলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর এই উদ্যোগ। তবে প্রান্তিক অঞ্চলে পা দেওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন এই সমস্যার শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে আরও গভীরে। গ্রামীণ ভারতে মৃগী, কুষ্ঠ, স্ট্রোক কিংবা হাইপারটেনশনের মতো রোগকে উপেক্ষা করার অন্যতম কারণ হল চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব। পাশাপাশি শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর খরচও যে কম নয়।
প্রান্তিক এলাকায় উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো গঠনের জন্য সরকারের কাছে তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন ঠিকই, তবে অপেক্ষা করেননি প্রশাসনিক পদক্ষেপের জন্য। বরং, একক উদ্যোগেই গড়ে তুলেছিলেন ‘বিন্দু মেনন ট্রাস্ট’। আস্ত একটি বাসকে বদলে ফেলেছিলেন ভ্রাম্যমাণ একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে। ২০১৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪৪টি প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে ‘নিউরোলজি অন হুইলস’-খ্যাত এই ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র, সঙ্গে বিনামূল্যে ওষুধ। সবমিলিয়ে প্রান্তিক অন্ধ্রপ্রদেশের চিকিৎসা পরিকাঠামোকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে তাঁর এই মানবিক উদ্যোগ…
Powered by Froala Editor