কাজাখস্তানের মধ্যযুগীয় শহর ওত্রার। বহু বছর ধরেই পরিত্যক্ত। ধরে নেওয়া হত, মোঙ্গল আক্রমণের পর থেকেই ধীরে ধীরে অস্তিত্ব মুছে গিয়েছিল এই শহরের। তবে সম্প্রতি নতুন তথ্য সামনে আনলেন গবেষকরা। যুদ্ধ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই মানুষকে ছাড়তে হয়েছিল এই মধ্যযুগীয় এশীয় নগরী।
ওত্রার বা ফারাব নামের এই শহর খ্যাত ছিল ‘ল্যান্ডস অফ থাউস্যান্ড সিটিস’ নামে। আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল এই শহরের। প্রথম থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে শিল্প কিংবা বাণিজ্যে শিখরে পৌঁছেছিল ওত্রার। সিল্ক রুটের মধ্যবর্তীস্থানে অবস্থানের জন্য ভারত, চিন প্রভৃতি এশীয় দেশগুলির সঙ্গে আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আরবের সংযোগের মূলকেন্দ্র ছিল এই শহর।
ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকেই চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা আক্রমণ করে শহরটি। কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই বাড়তে থাকে আগ্রাসনের পরিমাণ। পাশাপাশি সেইসময় বাণিজ্যপথ সিল্ক রোডের গুরুত্বও বেশ খানিকটা কমে এসেছে। কাজেই ধীরে ধীরে জনবসতি হ্রাস পেতে পেতে পরিত্যক্ত হয়ে যায় এই শহর। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলল অন্য কথা।
আমস্টারডাম, লিঙ্কন, অক্সফোর্ড এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি সমীক্ষা চালান ওত্রার শহরে। রেডিও কার্বন ডেটিং বা আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে অপটিক্যাল স্টিমুলেটেড লুমিনেসেন্স ডেটিং-এর ব্যবহারে ওত্রারের প্রাচীন জলাশয় এবং পলিমাটির আস্তরণের পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকরা। এই পদ্ধতিতে দেখা হয়, বালি বা পলিমাটির কণাগুলি ঠিক কখন সূর্যালোকের সংস্পর্শে এসেছে। আর সেখান থেকেই উঠে আসে ভিন্ন চিত্র।
না, মঙ্গল আক্রমণ নয়। তারও প্রায় একশো বছর আগে থেকেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এই মধ্যযুগীয় সভ্যতা। অন্যান্য যে কোনো সভ্যতার মতোই এই শহরও গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করেই। সিরি দরিয়া এবং আর্য নদীর বৃহত্তর উপত্যকায় অবস্থিত এই শহর। শহরের ব্যাপ্তি ২ বর্গ কিলোমিটার হলেও, তার সঙ্গেই সংযুক্ত ছিল প্রায় ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের উর্বর জমি। আর কাজাখ মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত এই আবাদযোগ্য মরুদ্যানই ছিল সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রধান কারণ।
গবেষকরা চিহ্নিত করেন, একাদশ শতকের শেষের দিক থেকেই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে মরুদ্যানের অধিকাংশ সেচ প্রকল্প। যা তৎকালীন সময়ে পরিচিত ছিল ‘ট্রান্সস্যাকানিয়া’ নামে। অস্বাভাবিক গতিতে মরু অঞ্চলের বৃদ্ধি এবং এই দোয়াবের শুকিয়ে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় ওত্রারের কাছে। চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র আমদানির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ফলে ধীরে ধীরে ওত্রার ছাড়তে থাকেন তার আদি বাসিন্দারা। মঙ্গল আক্রমণ এবং যুদ্ধ সেই গতিকেই আরও ত্বরান্বিত করেছিল পরবর্তী সময়ে।
আরও পড়ুন
৫০০০ বছর আগেও মুদ্রার ব্যবহার ছিল প্রাচীন ইউরোপে, দাবি বিজ্ঞানীদের
গবেষকদের এই তত্ত্ব এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণই যেন ওত্রারের অতীতকে মিলিয়ে দেয় সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে। সেখানেও মূল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই প্রকৃতিই। শুধু ওত্রারের ক্ষেত্রে ধ্বংস এবং সংস্কৃতির পতনের কারণ খরা। তফাৎ এটুকুই। কিন্তু এতকিছুর পরেও ওত্রারে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই থেমে থাকেনি। পঞ্চদশ, সপ্তদশ এবং উনবিংশ শতকে বারবার যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওত্রার। অবশ্য উনিশ শতকের শেষ দিকে কমতে কমতে সেই মরুদ্যানের আয়তন এসে ঠেকেছিল মাত্র ৫ বর্গ কিলোমিটারে…
Powered by Froala Editor