নবদ্বীপ ঘাট থেকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে একটি ঘোড়ার গাড়ি। গন্তব্য কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস। ব্রিটিশ সরকারের বেশ কিছু টাকা সেখানে মজুত রাখা হয়। সেই কাজেই ঘাট থেকে গাড়ি পৌঁছে যায় টাকা-ভর্তি সিন্দুক নিয়ে। শিমুলতলার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। হঠাৎই গাড়োয়ান দেখল, একটু এগিয়েই গাছের আড়াল থেকে একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। মাথার ওপর হুকুম, টাকাটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। তার ওপর চারিদিকে চলছে বিপ্লবীদের আনাগোনা। এমন অবস্থায় অচেনা কেউ ডাকলে বোধহয় এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। গাড়োয়ানও ওই ব্যক্তিকে গ্রাহ্য না করে এগিয়ে চলল…
শিমুলতলা জায়গাটা এমনিতে বেশ নির্জন। লোকজনের যাতায়াত খুবই কম; তার মধ্যে দিয়েই গাড়ি পার হতে হয়। সরকারি টাকা ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে পারলেই যেন বাঁচে গাড়োয়ান। সে গরিব মানুষ, বেশি কিছু বোঝে না। তাড়াতাড়ি ঘোড়া চালিয়ে সরে যেতে চাইল। কিন্তু, পারল না। একটু আগে যে ব্যক্তিটি বারবার তাকে ডাকছিল, তাঁরই পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। গাড়োয়ানের পা লক্ষ্য করে শুট করেছেন তিনি। এবার আশেপাশে অন্য গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল আরও বেশ কিছু মানুষ। সবার মুখে গামছা বাঁধা, সঙ্গে পিস্তল। সবাই এগিয়ে এসে ঘোড়ার গাড়ি থেকে লুট করল সরকারি টাকা। দলের নেতা যিনি, তিনি সগর্বে এবার পাড়ি দিলেন পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এমনই ছিলেন বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র। অভিযানের সময় যার বয়স কুড়িও পেরোয়নি…
অবিভক্ত বাংলার নদিয়াতেই জন্ম অনন্তহরি। বঙ্গভঙ্গের ঠিক এক বছর পরেই বেগমপুরের মাটি পায় তাঁর বীর সন্তানকে। বাংলা তখন রীতিমতো ফুঁসছে। প্রশাসনিক কাজের ‘অসুবিধা’র কারণ দেখিয়ে বাংলার শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন, তা বুঝে ফেলতে দেরি হয়নি অনেকের। রাস্তায় রাস্তায় স্বদেশি আন্দোলন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেমে আসছে তীব্র প্রতিরোধ। এমনই পরিস্থিতির মাঝে বড়ো হচ্ছিলেন অনন্তহরি। ফলে অল্প বয়স থেকেই তাঁর ভেতরে তৈরি হয় স্বাধীনতা চেতনা। ধীরে ধীরে অনেক মানুষের মতো মহাত্মা গান্ধীর পথকেই আদর্শ ধরে শুরু করেছিলেন পথ চলা। অতঃপর এল অসহযোগ আন্দোলন। ১৫ বছরের অনন্তহরি যুক্ত হয়ে গেলেন সেই আন্দোলনে। তখনই ১৯২১ সালে প্রথমবার গ্রেফতার হন।
নাবালক বলে সাজাও কম হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাই অনন্তহরির চিন্তা জগতে আনল এক বিশাল বদল। তখন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটো ধারা তৈরি হয়েছিল— নরমপন্থী ও চরমপন্থী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অনন্তহরি মিত্রের নরমপন্থীদের ওপর আস্থা চলে গেল। তাঁর মনে হল, এদেশকে স্বাধীন হতে গেলে ব্রিটিশদের মুখের ওপর জবাব দিতে হবে। তাঁদের সমানে সমানে লড়ে যেতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। অনন্তহরি বেছে নিলেন বিপ্লবের পথ। এই রাস্তাই এবার হবে তাঁর ধর্ম। স্বাধীনতার ধর্ম…
ছিলেন কৃষ্ণনগরে। সেখান থেকে সোজা চলে আসেন কলকাতায়। যোগ দেন রেড বেঙ্গল পার্টিতে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী কাজকর্ম ও সংগঠন তৈরির কাজ করতে লাগলেন এখানকার বিপ্লবীরা। অচিরেই তাঁদের একজন হয়ে কৃষ্ণনগর শাখার দায়িত্ব নেন অনন্তহরি মিত্র। অত কম বয়সেই পেলেন গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রক্ত ফুটছে টগবগিয়ে; যে করেই হোক কার্যসিদ্ধি করতেই হবে। এদিকে কলকাতায় তখন বিপ্লবীরা খুঁজছে নতুন আস্তানা। গুপ্ত আস্তানা, সেইসঙ্গে বোমা বানানোর কারখানা— দুটো কাজই যাতে নির্বিঘ্নে করা যায় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছিল। তখনই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে আড়িয়াদহের বাচস্পতি পাড়ার একটি বাড়ির সন্ধান পান তাঁরা। মোটামুটি নিরিবিলি জায়গা, এখানেই তৈরি হয় বোমা বানানোর আখড়া। তৈরি হওয়ার পর বাংলা তো বটেই, দেশের নানা জায়গায় পৌঁছে যেতে থাকে বোমা।
কিন্তু অস্ত্র তৈরি করতে গেলে রাসায়নিক কেনার জন্যও তো টাকার দরকার। তাহলে উপায়? বিপ্লবীরা নিজেদের টাকা ও জিনিসপত্র বিক্রি করে কতদিন চালাবেন? দল থেকেই প্রস্তাব উঠল, ডাকাতির রাস্তাই এখন সম্বল। তবে দেশের মানুষদের নয়; ইংরেজদের টাকা লুট করে নিজেদের কাজ চালানো হবে। আর এই পুরো কাজে সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র। কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিসে যে সরকারি টাকা জমা থাকে, সেটা তিনি জানতেন। পরে দেখলেন, যে পথ দিয়ে সরকারের ঘোড়ার গাড়ি যায়, সেটি নির্জন। দুয়ে দুয়ে চার করতে বেশি দেরি করেননি তিনি। দল তৈরি করে চলে গেলেন কৃষ্ণনগর। তারপরের ঘটনা তো শুরুতে বলাই হয়েছে…
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় দূরের কথা; ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে জল্লাদকে কী জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্ষুদিরাম?
কিন্তু সেখানে অজান্তেই ঘটে গেল একটা বিপদ। গাড়োয়ানের পায়ের দিকে গুলি করে যখন সরকারি টাকা লুঠ করছেন অনন্তহরিরা, তখন দূরে গাছের আড়াল থেকে এক গ্রামবাসী সেই দৃশ্য দেখে ফেলেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বুঝতে পারেনি সে, ভেবেছিল সামান্য ডাকাতি। কিন্তু পুলিশে খবর দিতেই তাঁদের কাছে ঘটনাটি পরিষ্কার হতে থাকে। সন্দেহ যায় অনন্তহরি’র ওপর। এদিকে তিনি কৃষ্ণনগর থেকে পালিয়ে দক্ষিণেশ্বরের বাড়িটিতে চলে আসেন। বেশ কিছুদিন তল্লাশি চালানোর পর ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণেশ্বরের ঘাঁটির সন্ধান পান ব্রিটিশ পুলিশ। সেখানে হানা দিয়ে বিস্তর পিস্তল, বোমা উদ্ধার করেন; সঙ্গে গ্রেফতার করেন বিপ্লবীদের। সেই দলে অনন্তহরি মিত্রও ছিলেন। শুরু হয় ‘দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা’। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
সেখানে গিয়ে অনন্তহরিদের নজরে পড়েন আরও একজন— ভূপেন চট্টোপাধ্যায়। পেশায় ছিলেন পুলিশ বিভাগের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট। আলিপুর জেলে এসে তাঁর কাজই ছিল রাজবন্দীদের সঙ্গে ভাব করা। তারপর দুর্বল মুহূর্তে ভেতর থেকে কথা আদায় করা। এরকম মানুষ যে বিপ্লবীদের রেড লিস্টে উঠে যাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কীসের! অনন্তহরি ও সঙ্গী বিপ্লবী প্রমোদরঞ্জন চৌধুরীকে ভূপেন চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হল। সেইমতো ১৯২৬ সালের মে মাসে আলিপুর জেলের ভেতরেই ভূপেন-কে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন দুজনে। এর ফল কী হবে, জানতেন অনন্তহরি। সবে ২০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। বিচারক নির্দেশ দেন মৃত্যুদণ্ডের। ফাঁসির দড়িকে পরোয়া করেননি অনন্তহরি মিত্রের মতো বিপ্লবীরা। হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৯২৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। বয়স? ওই যে বলা হল, মাত্র ২০!
তথ্যসূত্র—
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শাসনে প্রথম ফাঁসি, মহারাজা নন্দকুমারের হত্যাদৃশ্য দেখতে জনসমুদ্র কলকাতায়
১) ‘দক্ষিণেশ্বর ও একটি মামলা’, বার্তা টুডে
Powered by Froala Editor