কোথায় সেই শান্তির দেশ? খোঁজ ফুরোয়নি সমকামীদের

“রায়গঞ্জের যে গ্রামে আমার জন্ম, সেই গ্রামে যাওয়ার কথা শুনলে আমি এখন আঁতকে উঠি। কারণ, সেই গ্রাম আমাকে কতটা মেনে নেবে, না মেনে নেবে, জানি না। নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগাগুলোকে প্রতিমুহূর্তে আমাকে স্যাক্রিফাইস করে যেতে হয়। একটা লড়াই করে যেতে হয়।”

গতকাল ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর। হ্যাঁ, ২০১৮ সালে এই দিনেই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। ৩৭৭ ধারা পরিমার্জনের মাধ্যমে জানানো হয়েছিল ভারতের বুকে সমকামিতা অপরাধ নয়। সমকামিতার ওপর থেকে সরে গিয়েছিল অপ্রাকৃতিক যৌনতার তকমা। তারপর কেটে গেছে তিন তিনটি বছর। কিন্তু আদৌ কি স্বাধীনতা কিংবা মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন সমাজের প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষেরা?

গতকাল ঐতিহাসিক এই দিনকে মাথায় রেখেই একটি ভার্চুয়াল আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল কলকাতার এলজিবিটিকিউ অধিকার সংগঠন ‘প্রান্তকথা’। সহযোগী প্রহর.ইন। ‘মোদের কোন দ্যাশ নাই’ শীর্ষক সেই আলোচনাতেই শুরুর কথাগুলো বলছিলেন উত্তরবঙ্গের সমকামী যুগল রবি-বিনন্দন। কথা বলতে বলতে ভিজে আসছিল কণ্ঠস্বর। বছর তিনেক আগে শুধুমাত্র লিঙ্গপরিচয় জানানোর জন্যই তাঁদের ছাড়তে হয়েছিল নিজের জন্মস্থান, পরিবার, শৈশবের স্মৃতিচিহ্ন, পছন্দের সবকিছু। 

“৩৭৭ পরিমার্জনের ৩তম বছরে দাঁড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনার একটা দরকার ছিল। সেইসঙ্গে এটাও মাথায় রাখা দরকার, ভারতে এলজিবিটি আন্দোলন শক্তিশালী হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশ, সিকিম, ভুটান— ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার তরুণ-তরুণীরাও এই একই ঔপনিবেশিক আইনের সমস্যার মধ্যে পড়ে রয়েছেন। ভারত হয়তো খানিকটা এগিয়েছে, কিন্তু ৩৭৭-এর প্রভাব এখনও বর্তমান আমাদের উপমহাদেশে। ভারতের যেসব তরুণ-তরুণীরা মুখ খুলেছেন, তাঁদের অবস্থানটা বোঝাও দরকার ছিল”, বলছিলেন ‘প্রান্তকথা’-র কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়।

এদিনের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শুধু রবি-বিনন্দনই নন, অনুষ্ঠানে কানাডা থেকে হাজির ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিক তানভীর, কলকাতার সুজিত মণ্ডল। সকলকেই কমবেশি একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কথায় কথায় উঠে আসছিল কঠিন বাস্তবের ছবি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ৩৭৭ অবলুপ্ত হওয়ার তিন বছর পেরিয়ে এসে কেবলমাত্র আইনি স্বীকৃতিটুকুই পেয়েছে সমকামিতা। এতটুকু বদল আসেনি সমাজে, মানসিকতায়। আর এই দোলাচলের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন হাজার হাজার প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার তরুণ-তরুণী।

বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় জানালেন, “সম্প্রতি, তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর আমাদের সামনে এসেছিল আফগান বহু এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষ এবং নারী বাস্তুহারা হচ্ছেন। এটা তো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত গেল। রিফিউজির দুটো অংশ থাকে। দেশের ভেতরে হলে সেটাকে আমরা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট বলি। এই দুটো ঘটনাই কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের কথা অনুযায়ী নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন। এবং সেই কারণেই ‘মোদের কোন দ্যাশ নাই’ পংক্তিকে সামনে রেখে আমাদের এই আলোচনাসভা।”

কিন্তু কীভাবে খুলবে সেই স্বাধীনতার পথ? কীভাবে ভাঙা সম্ভব এই বেড়াজাল? “এই সমতা ফেরাতে গেলে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে”, গতকালের আলোচনায় উল্লেখ করেছিলেন আত্মবিশ্বাসী তানভীর। নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েই জানাচ্ছিলেন, পায়ের মাটি শক্ত থাকলেই একমাত্র লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা। 

প্রশাসন কতটা উদ্যোগী সেক্ষেত্রে? আজ থেকে বছর তিনেক আগে পরিস্থিতি যেমন ছিল, আজও ভারত এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের সরকার ঠিক ততটাই নিরুত্তাপ এই বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু হতোদ্যম হতে নারাজ এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষ এবং অধিকারকর্মীরা। বরং, অক্লান্তভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের পৃথক দেশ বানানোর লড়াই। নিজেদের অধিকারের লড়াই। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More