উলুবেড়িয়ার গঙ্গার ধারে, একটি ছোটো পানের দোকান হামিদ শেখের। শব-এ- বরাতের পরেরদিন, কথা হচ্ছিল হামিদ শেখের সঙ্গে। এলাকায় পাশাপাশি কালীমন্দির, দুর্গামন্দির বা মসজিদ আছে, কোনো সমস্যা হয় না? পরিষ্কার উত্তর দিলেন, গত বছর অবধি ভয় করত, কিন্তু এবছর সেই ভয়টা নেই। ওই তো দেখুন, আমার ভাই দুলাল শেখ আর পাশের বাড়ির বাচ্চু ঘোষ, কেমন একসঙ্গে ক্যারাম খেলছে ক্লাবের ঘরে? সামনের সপ্তাহে এই ক্লাবের থেকেই একটা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে, ওই ক্লাবের সামনের মাঠে, যা আবার মসজিদের লাগোয়া, সবাই তো ওখানে রক্ত দিতে আসবে। গত বছর এই সময়ে কি টেনশন, সারাক্ষণ শুধু হিন্দু মুসলমান চলছিল। আরে দাদা, আমরা তো একসঙ্গে বড়ো হয়েছি, বাচ্চুর মাকে তো আমি পিসি বলে ডাকি, আমাদের তো নিজস্ব কোনো বিভেদ নেই, বাচ্চুরও চাকরি নেই, আমারও নেই। ও টোটো চালায়, আমি এই দোকান দিয়েছি, সুতরাং আমাদের মধ্যে আবার বিভেদ কোথায়? আমরা একসঙ্গে সুখ-দুঃখে পাশে থাকি, ভবিষ্যতেও থাকব।
কিন্তু বিজেপি এলে কি এই কথাগুলো এত জোরের সঙ্গে বলতে পারতেন?
জানি না, সেই জন্যেই তো আমরা সবাই মিলে বলেছি আর যাকে পারিস ভোট দিস ভাই, বিজেপিকে দিস না। সব জায়গায় হয়তো এই আওয়াজটা পৌঁছয়নি, না হলে এই এতগুলো বিধায়কও পেত না ওঁরা।
আপনি কি ওই ‘বিজেপিকে ভোট নয়’ প্রচারের সঙ্গে ছিলেন?
না, আমি সরাসরি ছিলাম না, আমাদের অঞ্চলের কেউ কেউ ছিল, যাঁরা পোষ্টার এনেছিল, সেই সব লাগানো হয়েছে। আসলে দাদা, এই বিধানসভার ভোটটা ছিল বাঁচা মরার লড়াই, তাই আমরা চেয়েছি বিজেপিকে আটকাতে, আমরা সফল।
যে সময়টা বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির প্রভাব বাড়ছিল, যে সময়টা মনে হচ্ছিল যে বাংলাও বোধহয় বিজেপির দখলে চলে যাবে, সেই সময়েই অমোঘ শ্লোগানটি উঠে এল, নাগরিক সমাজের মধ্যে থেকে, যে আর যাই হোক ‘বিজেপিকে ভোট নয়’। কোনো-কোনো বাম রাজনৈতিক দল এই শ্লোগানকে সামনে রেখে মিটিং মিছিলও করলেন। বামফ্রন্ট- কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট যৌথভাবে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করে এবং নির্বাচনে আলাদা করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মানুষের কাছে এই বার্তা নিয়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করে যে বিজেপি এবং তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, সুতরাং উভয় দলকেই প্রত্যাখ্যান করা জরুরি। অথচ দৈনন্দিন খবরাখবরের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে কিন্তু একটা ভীতি কাজ করছিল, যে যদি একবার বিজেপি এই বাংলায় ক্ষমতায় আসে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাংলায় যে দীর্ঘদিন হিন্দু- মুসলমান একসঙ্গে পাশাপাশি বাস করার প্রথা আছে, তা কোথাও একটা বাধাপ্রাপ্ত হবে। বিজেপির রাজনীতির যে সর্বগ্রাসী প্রবণতা আছে, তা কোথাও একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও ভেঙে দিতে পারে। বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের যে রাজনীতি, সমস্ত কিছুকে তার যে সমজাতীয় করে দেওয়ার প্রচেষ্টা তা বাংলার ক্ষতি করতে পারে। বাংলার বিভিন্ন জেলায় খাদ্যাভাসের বা পোশাক পরিচ্ছদের যে পার্থক্য আছে, বাংলার উৎসব, পালা পার্বণের সঙ্গে যে উত্তর ভারতের বা পশ্চিম ভারতের যে পার্থক্য আছে, তা বিজেপি ক্ষমতায় আসলে অচিরেই ঘুচে যাবে। সেই জায়গা থেকেই মানুষ বিজেপিকে একটিও ভোট নয় এই শ্লোগানের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন। ফলে যাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন বিজেপি এবং তৃণমূলের কোনো মূলগত পার্থক্য নেই, তাঁরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। নির্বাচনের নিরিখে তাঁরা শূন্য পেয়েছেন।
সেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে বামেদের অন্দরে হয়তো এই নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে। বলা হয়েছে সেই সময়ে ‘বিজেমূল’ এই শব্দবন্ধটি ভুল ছিল। কিন্তু তাও সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের আস্ফালন কমেনি। তাঁদের অনেকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, যে সংগঠন যাই বলুক না কেন, তাঁরা ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব থেকে সরছেন না, এবং যে বা যাঁরা বিজেপির ত্রাসকে তৃণমূলের থেকে বেশি ভয়ঙ্কর বলেছেন, তাঁদের কদর্য ভাষায় আক্রমণ করতেও ছাড়েননি। তারপরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বিজেপি থেকে বহু নেতা মন্ত্রী আবার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাবুল সুপ্রিয়। কেন, কী উদ্দেশ্যে বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তা নিয়ে নানান বিশেষজ্ঞের নানান মত আছে। অনেকে বলে থাকেন, তিনি তৃণমূলে যোগদান করলেও কি তাঁর হিন্দুত্বের রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেছেন? অনেকে বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু বিজেপির বিরোধী এবং কোনোদিনই সংঘ পরিবারের রাজনীতির বিরোধিতা করেননি, তাই বাবুল সুপ্রিয়র পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। অনেকে বলছেন, এই বাবুল সুপ্রিয় বা জয়প্রকাশ বা অন্যান্যরা যাঁরা বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন বা ভবিষ্যতে আসবেন, তাঁদের কাছে বিজেপির বেশ কিছু গোপন খবরাখবর আছে, তাই তাঁদেরকে দলে নিয়ে বিজেপির হাঁড়ির খবর আরও বেশি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁদের নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে যাই হোক না কেন, এখন বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসার পরে কি চরিত্রগতভাবে বাবুল সুপ্রিয় বা তাঁদের মতো মানুষদের কোনো মূলগত পরিবর্তন হয়েছে?
যে বাবুল সুপ্রিয়কে আজকে তৃণমূলের পক্ষ থেকে সুব্রত মুখার্জি মারা যাওয়ার পরে, বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করা হয়েছে, তাঁকে কি সেই কেন্দ্রের নির্বাচকেরা মন থেকে মেনে নিতে পারছেন? আসানসোল দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকা কি বিস্মৃত হওয়া যায়? রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বা প্রত্যেক মুসলমানদের জেহাদি ভাবার মতো ধারণা কি তাঁর মন থেকে রাতারাতি উবে গেছে? আসানসোলের পুত্র হারা ইমাম রশিদী, যদিও বলেছেন, তাঁর মনে কারুর প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, এবং কেউ চাইলে দলবদল করতেই পারেন, কিন্তু নাগরিক সমাজ এই বাবুল সুপ্রিয়কে মেনে নিতে পারছে না। সামাজিক মাধ্যমে বাবুলের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২১ সালে বাংলার জনগণের কাছ থেকে এইরকম একটি আদেশ পেয়েছেন, তিনি কী করে বাবুল সুপ্রিয়র মতো একজন আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক, মুসলমান বিদ্বেষী মানুষকে বালিগঞ্জের মতো কেন্দ্রে প্রার্থী করলেন, যেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ মুসলমান নির্বাচক আছেন? তাই আবারো নাগরিক সমাজ সোচ্চার হয়েছে, মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় সহ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা নানান সংগঠনের পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে আওয়াজ উঠেছে বালিগঞ্জে ‘বাবুলকে ভোট নয়’। এরপর অনেকে হয়তো রাস্তাতেও নামবেন, বাবুল সুপ্রিয়কে পরাজিত করার আহ্বান রেখে। গত ২১ সালের নির্বাচনে যখন আওয়াজ উঠেছিল ‘বিজেপিকে ভোট নয়’ তখন বামেদের একদলের তরফে বলা হয়, এই শ্লোগান তৃণমূলের সুবিধা করবে। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কী করে সেই সময়ে সেই শ্লোগানকে নিজের দিকে টানতে হয়, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন। তার ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। আজকে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে, সেই সময়ের বার্তাকে তিনি অগ্রাহ্য করতেই পারেন, কিন্তু তিনি যদি ভুলে যান গণতন্ত্রে মানুষই শেষ কথা বলে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। রামপুরহাটের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আবারও দেখিয়ে দিল, ক্ষমতার মদমত্তে আসীন হয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে কীভাবে উদগ্রীব হয়েছে আজকের তৃণমূল কংগ্রেস। গত একমাসে যতগুলো হত্যা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির পিছনে যে পুলিশি নিস্ক্রিয়তা বা অতিসক্রিয়তা আছে তা কি অস্বীকার করা যায়?
রাজনীতিতে সময়জ্ঞান খুব জরুরী একটি বিষয়। কোন সময়ে কোন কথাটা বলা উচিত, কোন স্থানে কোন কথা বলা উচিৎ নয়, কোন কর্মসূচি কখন ঘোষণা করতে হয়, কোন শ্লোগান কখন তুলে ধরতে হয়, এগুলো অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কোন আইন কখন ফিরিয়ে নিতে হয়, ফিরিয়ে নেওয়ার সময়ে কি বলতে হয়, এই সমস্ত কিছু নির্ধারণ করে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কতটা পারদর্শী হয়ে উঠেছেন জনগণের নাড়ি বুঝতে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখে আমরা তা যথেষ্ট ভালোভাবে বুঝি। যদি তা না করা যায়, তাহলে বারংবার চেষ্টা করা হবে, কখনো জোটসঙ্গী বদলে, কখনো মুখ বদলে, কিন্তু তাতে খুব কিছু লাভ হবে না, বা হয় না। যে সময়ে এই নাগরিক সমাজের আওয়াজ উঠছে বাবুলকে পরাজিত করার, সেই সময়ে বামেদের তরফে এখনও যে তাঁরা ঠিক, তাঁদের সূত্রায়িত ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব ঠিক, তা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন, বেশ কিছু বাম সমর্থক। যদিও প্রাক্তন এবং বর্তমান রাজ্য সম্পাদক বুঝতে পারছেন, যে এই সময়ের দেওয়াল লিখন বাবুল সুপ্রিয়কে পরাজিত করতে আওয়াজ তুলতে হবে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের বামেদের সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাঁরা এখনও মনে করেন, যে তাঁরাই ঠিক ছিলেন, এবং যাঁরা সেই সময়ে ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ বলেছিলেন, তাঁরা ভুল ছিলেন এবং তাঁদের জন্যেই বামেদের ফল আজ শূন্য। তাই এই সময়ে যখন বাংলার বিধানসভায় একজনও বাম বিধায়ক নেই, যখন একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে বাবুল সুপ্রিয়কে পরাজিত করে একজনকে বিধানসভায় পাঠানোর, তখন সামাজিক মাধ্যমের এই ‘তুই বিড়াল না মুই বিড়াল’ মার্কা লড়াই কি ভবিষ্যতের ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের ক্ষতি করবে না? যার মধ্যে দিয়ে বিরোধী রাজনীতির পরিসরটা ক্রমশ আরও দক্ষিণপন্থী হয়ে উঠবে না? আজকে বাবুল সুপ্রিয়কে বালিগঞ্জে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে সেখানকার নির্বাচকদের ওপরে তাঁকে নির্বাচিত করতে কার্যত বাধ্য করছে শাসকদল। অথচ যে বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ৫০ শতাংশ মুসলমান মানুষ বাস করেন, সেই নির্বাচকদের থেকে কি একবারও জানতে চাওয়া হয়েছে, তাঁরা বাবুলের মতো একজন অসংবেদনশীল মানুষকে মেনে নেবেন কিনা?
এমনিতেই পাঁচ রাজ্যের ফলাফলের পরে বিভিন্ন রাজ্যে আম আদমি পার্টির প্রভাব বাড়ছে, বাংলাতেও তারা শাখা বিস্তার করার চেষ্টা করছে। যে আম আদমি পার্টি দিল্লির দাঙ্গার সময়ে নিশ্চুপ ছিল, যে আম আদমি পার্টি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে তদন্তের সময়ে একটাও আওয়াজ করেনি, উল্টে সম্মতি জানিয়েছে, যে আম আদমি পার্টি কোভিড সংক্রমণের সমস্ত দায় তবলিগ জামাতের ওপর চাপিয়েছিল, তাঁরা যদি বাংলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে, তা কি বাংলার রাজনীতির জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনতে পারে? যে বাংলা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ছুঁড়ে ফেলেছে, যে বাংলার রাজনীতি আসলে মননে বামপন্থী, তাঁরা যদি আজকে বাবুল সুপ্রিয়কে পরাজিত করার সুযোগ হাতছাড়া করে, তাহলে আগামী দিন যে আরও ভয়ঙ্কর তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সুতরাং বাবুল সুপ্রিয়কে নির্বাচনে পরাজিত করার মধ্যে দিয়ে বাংলার শাসকের কাছে এই বার্তাও পৌঁছনো সম্ভব, চারিদিকে যে মাত্রাছাড়া রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে, যার বলি হচ্ছেন মূলত সংখ্যালঘুরাই, শুধু তাঁরাই নন, সমস্ত মানুষ, যাঁরা গত নির্বাচনে ভয় থেকে হোক বা অন্য যে-কোনো কারণে তৃণমূলকে উজাড় করে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু গণতন্ত্রের আসল চালিকাশক্তি। আজকের সময়ের দাবি এটাই যে বালিগঞ্জ কেন্দ্রে বাবুল সুপ্রিয়র মতো একজন আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক মানুষকে একটিও ভোট নয়। এর মধ্যে দিয়ে এই বার্তাও শাসকদলের কাছে পৌঁছনো যাবে যে তৃণমূল এই রকম নির্বিচার রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালাচ্ছে, সেই তৃণমূল দলের বিরুদ্ধে কিন্তু নাগরিক সমাজ আওয়াজ তুলতে ভীত নয়।
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার। মতামত ব্যক্তিগত।)
Powered by Froala Editor