‘মানবিক না হতে পারলে ঠাঁই হবে শুধু ইতিহাসের পাতাতেই। দম্ভ, বীরত্ব, অহংকার— এগুলো যথেষ্ট আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি তা বোঝার জন্য। এখনও সময় রয়েছে সহনশীল ও নমনীয় হওয়ার...’, গর্জে উঠেছিলেন তিনি। ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সেঁটে দেওয়াই হয়তো স্বাভাবিক ছিল আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। তবে তাঁর বক্তব্য ও যুক্তির সামনে সেদিন মাথা নত করেছিল প্রশাসন, বিশ্বের অন্যতম শক্তি যুক্তরাজ্য।
জান মরিস। একটিমাত্র কথায় তাঁকে বোঝানো কার্যত অসম্ভব। লেখক, সাংবাদিক, কবি, কথা-সাহিত্যিক, অভিযাত্রী— বার বার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আত্ম-অনুসন্ধান করেছেন মরিস। গত শনিবার ৯৪ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ব্রিটেনের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অন্যতম সাহিত্যিক এবং প্রতিবাদী সত্তা। সেইসঙ্গে শেষ হল এলিজাবেথ যুগের দীর্ঘ এক অধ্যায়।
জন্ম ১৯২৬ সালে সাসেক্স শহরে। বছর তখন মাত্র ৪ বছর। শারীরিকভাবে পুরুষ হওয়ার সত্ত্বেও মরিস অনুভব করেছিলেন তিনি আসলে হতে চান একজন নারী। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর বাড়িতে এই কথা জানালে, মেনে নেয়নি পরিবার। কাজেই শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র সব জায়গাতেই নাম লেখাতে হয়েছিল পুরুষ পরিচয়েই।
সাসেক্সের ল্যানসিং কলেজ পড়াশোনা করেন তিনি। তখন ইউরোপজুড়ে বিশ্বযুদ্ধের আবহ। দেশের হয়ে যুদ্ধে প্রাণ দেওয়াতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছেন কৃষক থেকে শিক্ষক, দোকানি, ছাত্রসমাজ সকলেই। নাম লেখাচ্ছেন ফৌজির খাতায়। মরিসের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি তার। ইচ্ছে থাকলেও বর্ণান্ধত্বের জন্য জায়গা হয়নি পছন্দের নেভিতে। তবে সুযোগ পেয়েছিলেন রানীর নবম অশ্বারোহী বাহিনীতে লড়াই করার।
যুদ্ধ শেষ হতে জীবনে শুরু হল নতুন এক অধ্যায়। সৈনিকের জীবন থেকে তিনি আবার ফিরে এলেন শিক্ষার্থী-জীবনে। অক্সফোর্ডের ক্রিস্ট চার্চ কলেজে ভর্তি হলেন ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে। স্নাতক করার পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ বছরের জন্য ফেলোশিপ করতে যান মরিস। তবে অধিকাংশ সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলিতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন তিনি। আর তার ফল স্বরূপই জন্ম নেয় তাঁর প্রথম বই ‘কোস্ট টু কোস্ট’।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে মরিস পা দিলেন সাংবাদিকতায়। কায়রোর একটি সংবাদমাধ্যম দিয়েই শুরু হল সেই জীবন। পরে অভিজ্ঞতার সূত্রে সুযোগ মিলল বিখ্যাত ‘দ্য টাইমস’-এ। ১৯৫৩ সালে সাংবাদিক মহলে রীতিমত সাড়া ফেলে দেন মরিস। এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নরগে’র এভারেস্ট বিজয়ের খবর প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর দৌলতেই। তবে প্রতিযোগিতা তো ছিলই। অভিনব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই সেই পরীক্ষা উতরে গিয়েছিলেন মরিস। এভারেস্টের বেসক্যাম্প থেকে খবর পাওয়া মাত্রই সাংকেতিক টেলিগ্রামে সেই খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন লন্ডনে ‘টাইমস’-এর দপ্তরে।
আরও পড়ুন
মুসলমান কবিরা লিখলেন শ্যামাসঙ্গীত, কালিকামঙ্গল - বাংলার ভক্তি ও মিলনের ইতিহাস
তবে চিরকালই ছিলেন স্পষ্টভাষী। প্রতিবাদ করতে পিছপা হননি কখনো মরিস। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের বক্তব্য পছন্দ না হওয়ায় ছেড়েছিলেন অফিস। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায়। সে সময় হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মিশর-আক্রমণের কথা। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ইজরায়েলকে মিশর আক্রমণে ক্রমাগত ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন। যদিও অস্বীকার করেছিল এই তিন দেশই।
সেই রহস্যেরই পর্দা উন্মোচন করেন জান মরিস। নিজে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেন মিশরের নেগেভ মরুভূমির যুদ্ধ। ভৌগলিক অবস্থান দেখেই স্পষ্ট হয়ে যায় কারণ। মরু অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে চলা খালের দখলদারি নিতেই আসলে উঠে পড়ে লেগে ব্রিটেন। কিন্তু দরকার প্রমাণের। তাও সংগ্রহ করলেন তিনি অভিনব উপায়ে। বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা করলেন এক ফরাসি যুদ্ধবিমান চালকের সঙ্গে। খোলামেলা আলাপ জমিয়ে আদায় করলেন কথা। হ্যাঁ, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যৌথ ভাবেই বোমাবর্ষণ করেছিল ইজরায়েলের সমর্থনে।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই মুহূর্তে নাড়িয়ে দেয় বিশ্বরাজনীতিকে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় ইউরোপের দুই প্রধান শক্তি। কয়েকমাস পরে পদত্যাগ করেন স্বয়ং ব্রিটেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনিও ইডেন।
আরও পড়ুন
কবিতা কি বাবার লিখে দেওয়া নাকি মায়ের নকল - 'বুনো' নবনীতা ও উত্তরাধিকারের গল্প
তবে এই সাফল্যের পরও সাংবাদিকতায় থাকেননি খুব বেশিদিন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে যখন আসছে একের পর এক ডাক, সেই সময়ে সাংবাদিকতাকে বিদায় জানালেন মরিস। ঠিক করলেন এবার লিখবেন ভ্রমণকাহিনি। যদিও পরে নিজেই স্বীকার করেছিলেন, কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়াই তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল না কোনোদিন। আসল উদ্দেশ্য ছিল সেখানের মানুষ, সংস্কৃতি, ইতিহাসকে তোলপাড় করে দেখা।
এই একই বছর আরও একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। লিঙ্গ-পরিবর্তন। বয়স ৩৮ পেরিয়েছে। ততদিনে তাঁর পাঁচ সন্তান। রয়েছে স্ত্রী-ও। তবে আজীবনের স্বপ্নপূরণ কি হবে না? পাশে দাঁড়ালেন স্ত্রী। নেওয়া শুরু হল মহিলা হরমোন, হল অস্ত্রোপচারও। ব্রিটেনের প্রথম কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি হিসাবে তিনিই পরিবর্তন করেছিলেন লিঙ্গ।
কিন্তু বাধ সাধল অন্য একটা জায়গায়। ব্রিটেনে তখনও বৈধ নয় সমলিঙ্গ বিবাহ। কাজেই ডিভোর্স দিতে হল স্ত্রীকে। তবে তারপরেও একই সঙ্গে থেকেছেন তাঁরা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এমনকি জীবিত অবস্থায় মরিস নিজের এপিটাফের কথাও বেছে দিয়ে গিয়েছিলেন নিজেই। ‘জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বন্ধু’। জীবনসঙ্গী এলিজাবেথও চান মৃত্যুর পরে মরিসের সঙ্গে শায়িত হতে একই জায়গায়। এ যেন এক অমোঘ ভালোবাসার গল্প।
আরও পড়ুন
কবিতার সূত্রে সম্পর্ক, বিরহেই অমরত্ব পেয়েছিল দাগ দিলভি ও মুন্নিবাই-এর প্রেম
নিজের লেখা, কবিতায় এই ভালোবাসার কথাই লিখেছিলেন মরিস। নতুন করে খুঁজে দেখেছিলেন রোমান্টিসিজমকে। শেষ বয়সেও লিখেছিলেন একটি বই। মূলত ডায়েরিই। তবে প্রকাশ করেননি। চাইতেন সেই বই সামনে আসুক মৃত্যুর পরেই।
কবিতা, ঐতিহাসিক গল্প এবং একাধিক উপন্যাস লিখেছেন মরিস। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪০-এরও বেশি। শেষ বয়সে আক্রান্ত হয়েছিলেন স্মৃতিভ্রংশে। নিজেই মনে করতে পারতেন না কখনো কখনো নিজের লেখাদের কথা। অথচ তাদের কাছেই ফিরে যেতে চাইতেন আজন্মকাল। এই জীবন থেকে ছুটি নিয়ে সেই কবিতার রাজ্যেই হয়তো পাড়ি দিলেন মরিস। শিখিয়ে গেলেন একটা জীবনের অল্প সময়েই ঘুরে দেখা যায় অনেককিছু। সরব হওয়া যায় সমস্ত প্রতিকূলতা বিরুদ্ধেই...
Powered by Froala Editor