দিন-আনি দিন-খাই ছেলেটা একটা জানালা উপহার দিতে চেয়েছিল ছোটোবেলার স্কুলে। ছাপোষা একটা কাজের জন্য বাড়ি থেকে, বান্ধবীর থেকে অনেক দূরে থাকা ছেলেটার ব্যাগ-সুটকেস হঠাৎ একদিন বাস থেকে চুরি হয়ে যাওয়ার পর সেই ছেলের ইচ্ছে হয়েছিল ছোটোবেলার স্কুলটা ঘুরে আসতে একবার। তারপর আচমকাই একটা সমুদ্র ঢুকে এল ছোটোবেলার ক্লাসরুমে। ব্যাঙ্কের জমানো টাকা ভেঙে সেই ছেলে অর্ডার দিয়ে দিল একটা দামি কাঠের জানালার। কিন্তু স্কুলের বদলে চুরি হয়ে যাওয়া সেই জানালাও শেষমেশ পৌঁছে গেল একটা বিকিকিনির হাটে। হাট শেষ হলে দেখা গেল, শাল-সোনাঝুরির জঙ্গলের মাঝে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা জানালাটা। বিকিকিনির হট্টগোল শেষে সেটাই শুধু অবিক্রিত, তার কারণ হয়তো, একমাত্র সেটাই তৈরি হয়েছিল একটা ভীষণ তীব্র এবং সৎ ভালবাসার জায়গা থেকে। বাজার অর্থনীতি যতই আগ্রাসী মনোভাবে গিলে নিক সব কিছু, ভালবাসা কি কেনাবেচা যায়?
এরকমই ছিল তাঁর ছবি। বরেণ্য বাঙালি চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি। যেখানে তাঁর সৃষ্টিতে সবসময় জিতে গেছে মানুষ। তাঁর ভাবনায় সবসময় জিতে গেছে ভালবাসা। কিন্তু কখনোই ভীষণ গৎবাঁধা পথে এগোয়নি তাঁর ছবির ইমেজ। বরং খামখেয়ালি পাগলাটে সমস্ত চরিত্রেরা এসে ভিড় করেছে তাঁর সেলুলয়েডে। মালভূমির রুক্ষ রাস্তাঘাট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে সরকারি জন্ম নিয়ন্ত্রনের ফিল্ম দেখানো কাজ যে চরিত্রের, সে নইলে যেখানে সেখানে হরদম কেন দেখতে পাবে কল্পনার মতো সুন্দর একটা মুখ? পোয়াতি এক মহিলাকে অন্য একটা দেশে বেআইনি ভাবে পৌঁছে দিয়ে আসার ঝুঁকি সে নেয় ঠিক কোন স্বপ্নের দিনের আশায়? এসবই দেখিয়ে যেতেন তিনি, অদ্ভুত আলোর আকাশের নিচে। দেখাতেন একটা গাছকে কীভাবে ঈশ্বর করে তুলে তার হত্যা আটকিয়ে দেয় ক্ষমতাবানদের পায়ের নিচে থাকা সাধাসিধা গ্রামবাসীরা।
কোথা থেকে পেতেন এসব চরিত্র? কেন ছবির দৃশ্যায়নে বারবার পুরুলিয়া? অকপট বুদ্ধদেব বলেছেন, পুরুলিয়ার অমন দিগন্ত খোলা রুখাসুখা আনাড়ি খয়েরি সবুজ ছাড়া কোথায় ফেলবেন তিনি তাঁর পাগলাটে চরিত্রদের? গাছের উপর উঠে বসে থাকা পোস্টম্যান অথবা এমন এক রাজা যার বাড়িতে বন্দি রাজকন্যা। কিংবা শহরে ফিরতে গিয়ে লাস্ট ট্রেন মিস করে সারা রাত একটা স্টেশনে বসে থাকা একজন যাত্রী?
কলকাতায় ছোটোবেলা কাটাতে হয়নি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন বুদ্ধদেব। মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট কোনো গ্রাম অথবা পুরুলিয়ার উঁচুনিচু মালভূমি অঞ্চলে বড়ো হতে হতেই হয়তো ইমেজকে নতুন করে ধরতে পেরেছিলেন তিনি। তাই হয়তো ছোটবেলায় মা ঠাকুমাদের গল্প শুনতে শুনতে যখন ঘুমিয়ে পড়ে অন্যান্য শিশুরা, তখন বুদ্ধদেব নিজের মায়ের থেকে পেয়েছিলেন এক অপার্থিব শিক্ষা। মা যখন গান গাইতেন বা কবিতা পড়তেন, ছেলেমেয়েদের বলতেন চোখ বুজে শুনতে। সেই থেকেই মনে মনে গানের ভিতরের ছবির কল্পনা করা শুরু প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালকের।
আরও পড়ুন
চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই
প্রথম ছবি করার আগেই নাকি প্রায় পঞ্চাশটা ছবি বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি! কীভাবে? শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বাসে করে ফেরার সময় চোখ বুজে তিনি বানাতে শুরু করতেন নিজের ছবি। হঠাৎ একটা যে-কোনো গল্প বা চরিত্র ভেবে নিয়ে। মনে মনে নির্দেশ দিতেন সহকারীদের। লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন থেকে কাট হয়ে বাস থেকে নামার আগেই গোটা একটা গল্প দেখা হয়ে যেত মনে মনে তাঁর। এমন ভাবেও যে ছবি বানানো যায়, এই দর্শনটাই মনের ভিতরে গেঁথে নেওয়ার থেকে বড় আর কীই বা শিক্ষা পেতে পারে চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থীরা?
আরও পড়ুন
কবিতা থেকে সিনেমা - সর্বত্রই নতুন ভাষা খুঁজেছেন বুদ্ধদেব
কে না জানে, প্রাকৃতিক আলো আর আকাশ— এই দুটোই চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম পছন্দের দুটো বিষয় ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের? তারকাদের নিয়ে কাজ করলেও, সিনেমার থেকে বড় তারকা তাঁর কাছে আর ছিল না কিছুই। অবশ্য তারকাদেরও ইমেজ বা গ্ল্যামারের দিক থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের দারুণ ভাবে মাটির কাছের করে তুলতেও তো জুড়ি ছিল না তাঁর। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মিঠুন চক্রবর্ত্তী, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রাহুল বোস, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, পাওলি দাম, পার্নো মিত্র, চন্দন রায় সান্যাল, সমীরা রেড্ডি বা রিমি সেন— এঁদের যে পরিচিত লুক আমরা দেখতে অভ্যস্ত, একধাক্কায় সেখান থেকে সরিয়ে এনেও তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে দেখিয়ে ছিলেন অবলীলায়।
আরও পড়ুন
সংসারে অর্থকষ্ট, জন্মদিনে মেয়েকে কবিতা উপহার দিলেন বুদ্ধদেব বসু
সমাজ, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো যেমন বারবার ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে, তেমনই বারবার একটা আলোর দিশাও দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি। শুধু লড়াই, যুদ্ধ আর দখল নিয়ে ব্যস্ত একটা পৃথিবী, যা ভালবাসার খোঁজ রাখে না, টেলিগ্রামের থামে টরেটক্কা শুনে আশ্চর্য হয় না— সেই পৃথিবীরই উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে তিনিই আবার দেখিয়েছিলেন বেঁটে মানুষেরাও ভালবাসায় উঁচু হয়ে উঠতে পারে কত। ‘উত্তরা’ ছবিতে যখন ছোট্ট ছেলেটা প্রাণ বাঁচাতে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে, তাকে খুঁজছে একটু আগে গরিব গ্রামীণ পাদ্রিকে জ্বালিয়ে দেওয়া দুষ্কৃতিরা, তখন একদল নাটুয়া শিল্পী আগলে দাঁড়ায় সেই ছেলেটাকে। তাদের দেখে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। যেন, প্রকৃত শিল্পের কাছে এভাবেই বারবার হেরে যায় হিংসা আর উন্মত্ততা। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সবুজ শান্তির পৃথিবী দিয়ে যাওয়ার বেশি আর কীই বা করতে পারে একটা মানব সভ্যতা, এই বোধ তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বু্দ্ধদেবকে বারবার।
তাই হয়তো অনুশোচনায় বিদ্ধ একজন পিতাকে এঁকে ফেলেছেন তিনি, যিনি নিজের ছেলেকেও অনুসরণ করতে থাকেন শহর কলকাতার রাস্তাঘাটে; ট্রামের কামরায়। ‘তাহাদের কথা’ বা ‘টোপ’ ছবিতেও সেই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে গেলাম, সেই ভাবনা মনের ভিতর দেগে দেন পরিচালক, যিনি আসলে কবিতার মতো করে দেখেছিলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমটা। একটা গেঁয়ো মানুষের সারা শরীর জুড়ে পাখি, আর ঘুম ভাঙার পর যার ঘরের দেয়াল বলে কিছু থাকে না— আর, সেখান দিয়ে দেখা যায় সাগরময় মরশুমি পাখিদের ভিড়— পর্দায় এই ‘ম্যাজিক’ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তই দেখিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের। দেখিয়ে গিয়েছিলেন কীভাবে লাল দরজা খুলে যায় আশ্চর্য সহজ একটা ছড়ার মতো মন্ত্রে। কিংবা মহাকাশে রকেট পৌঁছে যাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে এক ‘মন্দ মেয়ের’ ধোঁয়া ওঠা ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ার গল্প।
চারপাশের ‘ইমিডিয়েট’, ‘প্রেডিক্টেবল’, ‘রিপিটেটিভ’ পৃথিবীটাকেই ছবির পর্দাতে আবার দর্শকের সামনে নিয়ে আসতে ঘোরতর অনীহা ছিল তাঁর। বাস্তব-অবাস্তবতার গণ্ডিটাই মুছে দেওয়াতেই লুকিয়ে ছিল তাঁর পরিচালনার ম্যাজিক। বাস্তবতার মধ্যে স্বপ্ন মিশিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর ছবির ভাষা। যে কারণে একজন ছাপোষা গরিব গোয়েন্দা সম্পর্কের রহস্য খুলতে খুলতে অবশেষে দেখা পায় তার স্বপ্নের না-মানুষীর। যেভাবে রানওয়ে থেকে উড়ান নেয় ছুটতে থাকা দুটো পা। কোথায় মিশে যায় তারপর তারা? আলোয়? আকাশে?
অপার্থিব দুনিয়াতেই পাড়ি দিয়েও হয়তো পরের কোনো ছবির কাস্টিং করে চলেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।
Powered by Froala Editor