পৃথিবীর তাবৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞানের দীর্ঘকালের প্রিয় বিষয় হল পৃথিবীর বাইরে উন্নত প্রাণজীবনের সন্ধান। এই মহাবিশ্বে আমরা কি একাই, নাকি আমাদের পরিচিত সৌরমন্ডলের বাইরে আরও অনেক গ্রহ বা এক্সোপ্ল্যানেট রয়েছে, যেখানে আছে পৃথিবীর মতোই হাওয়া-জল-অক্সিজেন আর উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত। তারই সন্ধানে গভীর মহাকাশের দূরতম প্রান্ত অবধি খুঁজে চলেছেন আজকের বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্ব নামক বিপুল গোলকটি সতত সম্প্রসারণশীল, ক্রমশঃ সে স্ফীতকায় হয়ে উঠছে আয়তনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির সাথে সাথে, বড় বড় রেডিও টেলিস্কোপ এবং মহাকাশে প্রদক্ষিণরত হাব্ল টেলিস্কোপের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এখন অতি গভীর মহাকাশের প্রায় ততদূর অব্দি দেখতে পেরেছেন, যেখান থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে লাগে প্রায় ৪৬০০ কোটি বছর। মনে রাখা যাক, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে লাগে আট মিনিটের একটু বেশি। সেই তুলনায় ৪৬০০ কোটি বছর! ওই গভীর মহাকাশ থেকে ছুটতে ছুটতে কেউ কি আমাদের সূর্যের পাড়াতেও কখনো এসে পড়ছে? কোনও নতুন অতিথি? হতে পারে সে কোনও গ্রহ, গ্রহাণু, বা ধূমকেতু, যারা আদতে এই সৌর মন্ডলের অধিবাসী নয়। এমনিতে তো কত ধূমকেতুকেই আমরা রাতের আকাশে দেখেছি। কেউ আসে বারবার। কেউ আসে অনেক বছর পার করে। কিন্তু তারা সকলেই তো আমাদের সৌরমন্ডলের মধ্যেই রয়েছে। আর যারা খুব কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে, রাতের আকাশের সেইসব উল্কাদের তো হামেশাই দেখেছি আমরা। কিন্তু তার চেয়েও আমাদের বেশি আগ্রহ ওই অতিথিদের নিয়ে, যারা বহুদূরের অন্য কোনও নক্ষত্র জগত থেকে পাড়ি দিয়ে সহসা এসে পড়েছে আমাদের সুর্যের পাড়ায় এবং দেখা দিয়ে আবার দ্রুতবেগে ফিরে চলে গেছে মহাকাশের গভীরে, অন্য কোনও নক্ষত্রলোকে। অতি সম্প্রতি আমরা চিহ্নিত করতে শুরু করেছি তাদের।
প্রথম অতিথির নাম হয়তো অনেকেরই মনে আছে। তার নাম ছিল ‘ওমুয়ামুয়া’। আমাদের সৌরমণ্ডলে সে যখন ঢুকে এসে আবার ফিরে যাচ্ছিল গভীর মহাকাশে, তার মাত্র কয়েকদিন দিন আগে তাকে আবিষ্কার করেছিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটি অ্যামেচার টেলিস্কোপ। হাওয়াই দ্বীপের আদিবাসীদের ভাষায় ওমুয়ামুয়া-শব্দের অর্থ দূর নক্ষত্রজগতের খবর নিয়ে আসা প্রথম অতিথি।
সে এসেছিল কিছুটা দুলতে দুলতে, টলতে টলতে। টাম্বলিং অ্যান্ড স্পিনিং। এত দ্রুতগতিতে সে সূর্য এবং পৃথিবীর কক্ষপথের অনেকটা কাছে এসে (নব্বই লক্ষ মাইল), আবার হঠাৎই পাড়ি দিয়েছিল নক্ষত্রজগতের গভীরে যে তার ছবিও ঠিক করে তুলতে পারা যায়নি। বোঝা যায়নি তার কক্ষপথ। তবে অনেক মাপজোক করে সন্দেহ হয়, সে ছিল প্রায় ৪০০-মিটার লম্বাটে একটা ঝামাপাথরের মতো বস্তুপিণ্ড, যার শরীরের একেকটা ফুটো দিয়ে মাঝেমাঝে তীব্রবেগে রুদ্ধগ্যাস বেরিয়ে এসে তার চলনকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। সে এসেছিল ‘ভেগা’ (Vega) নামক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সংসার ছেড়ে, বিবাগী হয়ে। তার আসল ফটো না পেয়ে বিজ্ঞানীরা একটা কল্পিত ছবি এঁকে প্রকাশ করেছিলেন, যা দেখতে অনেকটা চুরুটের মতো। তার টেকনিকাল নাম ছিল ‘1I/2017’; এখানে 1I মানে প্রথম ইন্টারস্টেলার। সেটা ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস। আমি তখন কবিদের কবিতাপাঠ ও জলযাত্রা নিয়ে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনা করছিলাম। ‘এম বি রাজমহল’-নামের সেই ছবিটি পরে উৎসর্গ করেছিলাম ওই প্রথম আন্তর্নক্ষত্রজগতের অতিথি ‘ওমুয়ামুয়া’-কে।
তো, উনি ছিলেন প্রথম, তাই এই সম্মান। এবার আসছেন দ্বিতীয়জন। এর নাম ‘2I/Borisov’; 2I মানে দ্বিতীয় ইন্টারস্টেলার। গত ৩০ অগস্ট ২০১৯ একে আবিস্কার করেন গেন্নাডি ভ্লাডিমিরোভিচ বরিসভ নামে এক রাশিয়ান জ্যোতির্বিদ। এবার বিজ্ঞানীরা ‘হাবল টেলিস্কোপ’ দিয়ে শুরু থেকেই নজরে রেখেছেন তাকে। এই একটা প্রথম ধূমকেতু, নাম ‘বরিসভ’, যে আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের এক নক্ষত্রজগত থেকে প্রবল বেগে এদিকে ছুটে আসছে, ঘণ্টায় এক লক্ষ সত্তর হাজার কিলোমিটার গতিতে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পৃথিবীর মাত্র দশ কোটি মাইলের মধ্যে দিয়ে চলে যাবে সে। আকারে সে ওমুয়ামুয়ার চেয়ে অনেক বড়, দশ-বারো কিলোমিটারের মতো, আর তার উজ্জ্বল লেজের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় দেড় লক্ষ কিলোমিটার। চেষ্টা করলে হয়তো দেখাও যাবে রাতের আকাশে, তবে খালি চোখে নয়, বড় টেলিস্কোপে। তার চলনপথের মাপজোক নিয়ে যে কক্ষপথের নকশা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাতে বোঝা যাচ্ছে সে ছিল পৃথিবী থেকে তেরো আলোকবর্ষ দূরে ক্রুগের-৬০ নামের একজোড়া নক্ষত্রের কাছেপিঠে। সেখান থেকে রওনা দিয়ে প্রায় দশ লক্ষ বছর ধরে ছুটতে ছুটতে আজ সে এসে পড়েছে আমাদের সৌরমণ্ডলে। তবে এখানে থাকতে নয়, দূর থেকে একটু দেখা দিয়ে সে চলে যাবে অন্য কোনও নক্ষত্রলোকের দিকে, যেমন তার মর্জি। এই বিশাল মহাবিশ্বে কে যে তাকে কোন দিক থেকে টান দিচ্ছে, কীসের টানে কোথায় সে ছুটে চলেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, কে জানে।