অস্তিত্বজুড়ে যখন খেলা করে বিপন্ন সময় : ইন্দ্রাশিস আচার্যের সিনেমা

একদা তরুণ মজুমদারের মতো সিনেমাওলা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হওয়া আমার এক কথাসাহিত্যিক বন্ধু কিছুদিন আগে আক্ষেপ করছিলেন, বাংলা সিনেমা আর দেখা যায় না। মধ্যনব্বই-এর ঋতুপর্ণ থেকে হাল আমলের টলিউড-আইকন সৃজিত পর্যন্ত - এই আড়াই দশক কীভাবে ও কেন বাংলা চলচ্চিত্রের পতনের গ্রাফ নির্মাণ করেছে, তিনি আমাকে সেটা বোঝাচ্ছিলেন। কথা বলে জানলাম, হাল আমলের যাঁদের কাজ তিনি দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ইন্দ্রাশিস আচার্য ছিলেন না। বন্ধুটিকে আমি প্রবোধ দিলাম, ইন্দ্রাশিসের কাজ দেখুন। সাম্প্রতিক বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণাও হয়তো আপনার বদলাবে।

ইন্দ্রাশিসের প্রথম কাজ 'বিলু রাক্ষস' বেরিয়েছিল ২০১৭তে। ২০১৭তে-ই রিলিজ হয়  'পিউপা'। ২০২০-তে প্রকাশিত 'পার্সেল' তাঁর সাম্প্রতিকতম কাজ। তিনটি সিনেমাই তথাকথিত মাল্টিপ্লেক্স দর্শকের কথা মাথায় রেখে নির্মিত। অবশ্য শেষ এক দশকের পরিসংখ্যানই বলে দিতে পারে, পাবলিক হল-রিলিজ-নির্ভর পপুলার বাণিজ্যিক সিনেমার দিন এখন ক্রমশ অস্তগামী। মোবাইল ফোন-নির্ভর ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলি জনপ্রিয় হওয়ার পর বাণিজ্যিক ও মাল্টিপ্লেক্স দর্শকের এদ্দিনকার প্রচলিত বিভাজনরেখাটিও ক্রমশ মুছে যেতে বসেছে। কাজেই, সিনেমা দেখতে বসে কোনো কাজকে মাল্টিপ্লেক্স বা ড্রয়িংরুমবিলাসী দর্শকের জন্য - বলে দাগিয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না এলে দর্শকেরও মুক্তি নেই। ইন্দ্রাশিসের কাজ দেখতে দেখতে এই কথাগুলিই আরও বেশি করে মনে হচ্ছিল। তাঁর নির্মিত সিনেমাকে দর্শক সাধারণের মধ্যে পৌঁছে না দিতে পারাটা আসলে আমাদেরই ব্যর্থতা, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিরই ক্ষতি।

ইন্দ্রাশিস খুব সরল পেলবতায়, অনুচ্চকিত স্বরে যেন আড়ম্বরহীন তাড়নাহীন এক আলস্যের ভিতর তাঁর দর্শককে ডুবিয়ে রাখেন, স্মৃতিকাতর করেন। পারিপার্শ্বিকতার ভিড় থেকে আমাদের নিঃশব্দে বিচ্ছিন্ন করে কখন যে অপরিসীম শূন্যতায় ঠেলে দেন তা বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আবিষ্কার করতে হয় এই বিরাট পৃথিবীতে আমি ভয়ানক একা, বিপন্ন এবং নির্বাসিত। 'বিলু রাক্ষস' 'পিউপা' কিংবা 'পার্সেল' - আদতে ওই বিপন্নতার চলচ্ছবি, নির্বাসিত ছিন্নবিচ্ছিন্ন এক একটি মানুষের গল্প। বিলুর গল্প কিংবা 'পিউপা'র শুভ্রর গল্পে যেমন, প্রথমেই আপনাকে টানবে একটা বৃহৎ ক্যানভাস--উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়া। ক্যানভাস একটু ছোটো হয়ে এলে দেখবেন গাড়িবারান্দার নিচে সদর দরজার পাশে বসবার রোয়াক, ওখানেই আড্ডায় বসতেন পাড়ার দাদা কাকুরা। ভিতরে ঢুকলেই সাবেককালের জীর্ণ উঠোনের চারপাশে বিরাট বারান্দা, রংচটা, ইতস্তত পলেস্তারা খসে-পড়া কার্নিসের কঙ্কাল, ঘোরানো বিরাট সিঁড়ি। স্মৃতি হাতড়ে এবার ঢুকে পড়ুন ঘরের মধ্যে : বিরাট এক একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে ভাঙতে এখন খুব ছোটো ছোটো বৃত্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ওই ছোটো বৃত্ত থেকে, অখণ্ড অবসর থেকে, বিলু কিংবা শুভ্রকে এখন অবধারিত টেনে নিচ্ছে আই টি সেক্টর, টেনে নিচ্ছে বৃহৎ পুঁজি। কিউবিকালের ছোটো ছোটো খোপ থেকে ওরা আরও বেশি করে ঢুকে পড়ছে ল্যাপটপের নীল স্ক্রিনে ও কী-বোর্ডে। ওয়ান বাই ওয়ান - প্রজেক্ট আর টার্গেট - রিচ করতে করতে ওরা হারিয়ে ফেলছে স্বজন আত্মীয়, প্রতিবেশী এমনকি প্রেম, প্রাত্যহিক মদের আসরও এখন পানসে লাগছে। টুকরো এক-একটা ক্যানভাসে ওরা ফ্রেমবন্দি। 

বিলু ওই পলেস্তারা-খসা জীর্ণতাকেই আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। তার যাপন থেকে একে একে সরে যায় পিতা মাতা, স্ত্রী সন্তান। এখন রাক্ষসের মতো হাঁ করে ওই ঘরই তাকে যেন গিলতে আসে। স্মৃতির পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে রানুদি-রা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠতে চাইলেও বিলুর মন তাকে কখনই স্বীকার করতে পারে না। বাজারি-মেয়ে ভাড়া করে তাঁদের দিয়ে কখনও বউ কখনও মা-এর রোল প্লে করাতে হয়। এভাবেই ক্রমশ শিকড়হারানো ভয়াবহ বিপন্নতা তাকে পেড়ে ফেলে। রাক্ষুসে স্মৃতি দিনরাত যেন গিলতে থাকে। বিলু এবার পালাতে থাকে, এক টুকরো শিকড়ের খোঁজে চলে যায় গ্রামের সবুজ ঘেরা মামার বাড়ি। কিন্তু কী খুঁজে পেতে চায় বিলু? ছেলেবেলায় যা সে ফেলে এসেছিল বড়োমামার চিলেকোঠার ঘরে? নদীর অবিরাম ঢেউয়ের ছন্দে দোলায়মান ডিঙিনৌকোর গলুইতে? সেই সব কি আর ফিরে পাওয়া যায় না? বিলুর দু-চোখ জুড়ে হ্যালুসিনেশন। জেগে ওঠে মৃত সব মানুষেরা। অবশেষে এক মায়াময় বিকেলে তিরতির বয়ে চলা জয়ন্তীর পাথুরে চরে বিলু খুঁজে পায় তার ছেলেবেলার দোসর---ছেলেবেলার লাজুক বিলুকে। বড়ো মায়াময় করে ইন্দ্রাশিস সেইসব ছবি আঁকেন। ছেলেটির হাত ধরে বিলু চলে যায় অনন্ত গোধূলির দেশে। পাহাড়ের এক খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বিলুকে সেই ছেলে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এই তো, আর বিভ্রম নয়, এইবার বিলু সত্যি সত্যি ফিরে গেছে তার কৈশোরে। কিন্তু এ কী, বিরাট চরাচর জুড়ে সে একা কেন, বাবা-মা কোথায়? বিলুর ভয় করে, সে দৌড়ায় আর প্রাণপণ হেঁকে চলে 'মা, বাবা, - তোমরা কোথায়?'

ইন্দ্রাশিসের সিনেমায় কোনো উচ্চকিত স্বর নেই, চমক নেই, ঘটনার নাটকীয় মোচড় নেই, তীব্র চাহিদা আছে কিন্তু শরীরের খেলা নেই, চটকদার স্ল্যাং নেই, প্রবাদ হয়ে উঠতে পারে নায়কের মুখে এমন কোনো অতিমানবীয় ডায়লগ নেই, এমনকী আপনাকে এন্টারটেইন করাতে পারে এমন সুপারহিট গানও নেই। ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা বানানোর কথা বলে কৌশলে এন্টারটেইনের চোরা গলিতে ইন্দ্রাশিস আমাদের টেনে নিয়ে যাননি। আবার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যেরকম তাঁর সিনেমায় ক্রমশ ঘটনাকে গৌণ করে কবিতার অ্যবস্ট্রাক্ট  জগতে চলে গিয়েছিলেন, সিনেমায় তেমন কোনো কবিতা লিখতে কিংবা ছবি আঁকতে আসেননি ইন্দ্রাশিস। বিশুদ্ধ নস্টালজিয়া কিংবা সস্তা ফ্যান্টাসিকে ইন্দ্রাশিস এড়িয়েই চলেন। বরং তিনি রিস্ক নেন - শুধু নেন না - অন্যদের থেকে একটু বেশিই নেন। খুব অনুচ্চকিত স্বরেই, তিনি তাঁর দর্শকদের এমন সব অস্বস্তির মুখে, প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেন, যা আমাদেরও বিপন্ন করে। 'পিউপা'তে মায়ের মৃত্যু, কোমায় চলে যাওয়া বাবার আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব নয় জেনেও, তাঁকে আঁকড়ে শুভ্র যখন খোয়াতে বসেছে উজ্জ্বল ভবিষ্যত - তার প্রেম এবং ঈর্ষণীয় কেরিয়ার - তখন কাকা রজত চ্যাটার্জিকেই হয়ে উঠতে হয় ত্রাতা। কিন্তু ইউনিভার্স কিংবা ইনফিনিটির ডাক শুনে ফেলা দাদাকে গোপনে 'হত্যা' করা রজত সমাজের চোখে কি সত্যিই ত্রাতা? না কি সে খুনি? না কি ইন্দ্রাশিস রাষ্ট্রের কাছেই আসলে ছুঁড়ে দেন ওই প্রশ্ন, আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত করেন তাঁর দর্শকদের।

ঠিক যেভাবে 'পার্সেল' হয়ে ওঠে আমাদের কাছে একটা ভাঙা আয়নার মতো। রাংতায় মোড়া সুদৃশ্য এক-একটা প্যাকেটের অন্তরাল উন্মোচিত হয় আর সঙ্গে সঙ্গেই এক-একটা ভাঙা আয়না আমাদের মুখের সামনে মেলে ধরেন ইন্দ্রাশিস। সেই দর্পণে আমাদেরই পাপবিদ্ধ অতীতের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে উঠি। এভাবেই এক-একটা দর্পণ তিনি মেলে ধরেন আর সেই অপরাধময় পাপবিদ্ধ অতীত দাঁতনখ নিয়ে জেগে ওঠে। আমরা ভয় পাই, কুঁকড়ে যাই। অসংলগ্ন, অপরাধী হয়ে উঠি। কী যেন লুকোতে চাই অথচ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে প্রতিমুহূর্তে সন্ত্রস্ত হই। মুখ ঢেকে রাখি মুখোশে। ক্রমশ মুখোশই মুখ হয়ে ওঠে। আমরা লুকোতে থাকি, পালাতেই থাকি আমাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে। এমনই ভয়াবহ সেই বাঁচাকে নাম দিই জীবন। ইন্দ্রাশিস এই মিথ্যা, বিকৃত, পচাগলা, দুর্গন্ধময় জীবনটাকে আমাদের সামনে মেলে ধরে বলেন - এই দেখুন, এটা আপনি, এই হল আপনার সাধের জীবন।

ইন্দ্রাশিসের সিনেমার সবচেয়ে বড়ো গুণ আশ্চর্য পরিমিতি বোধ। কোথাও এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। ক্যামেরার অনাবশ্যক কারসাজিতে দৃশ্যকে ক্যারেক্টারাইজড করবার চেষ্টা নেই। তাঁর সিনেমায় আলো কখনই বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে না। আলো-অন্ধকারের খেলায় দর্শকদের কোথাও তিনি অকারণ মুগ্ধ করেননি। তেমনি আশ্চর্য শব্দের ন্যাচরালিস্টিক প্রয়োগ। শব্দহীনতার জগৎ তাঁর জগৎ নয়। শব্দ থেকে পালানোর উপায় কি আমাদের কলকাতাবাসীদের আছে? নেই, সেটা অলীক। তাই প্রাত্যহিক মুহূর্তে ভরে ওঠা শব্দময় এই শহর, তার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম বৈচিত্র্য নিয়ে ইন্দ্রাশিসের সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করেছে। এমনকি 'পার্সেল'কে যদি সাইকোলজিকাল থ্রিলারও বলি, তাহলে চলতি থ্রিলারে যে-ধরনের যান্ত্রিক শব্দের তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যবহার আমরা দেখি, এখানে তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন। বিশেষ কোনো বাদ্যযন্ত্রের ন্যূনতম কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অর্থপূর্ণ প্রয়োগে কীভাবে একটি দৃশ্যের ক্যারেকটার তৈরি করা যায়, কীভাবে ঘটনায় নাটকীয় অভিঘাত তৈরি করা যায় তার অসামান্য উদাহরণ 'পার্সেল'-এ ভায়োলিনের প্রয়োগ। আবার 'বিলু রাক্ষস'-এ বিলু যখন মামার বাড়িতে গিয়ে গঙ্গার তীরে গিয়ে দাঁড়ায়, কল্পনায় মামার সঙ্গে কথা বলে, বলে 'মামা আমি তো কিছু কানেক্ট করতে পারছি না। সব কিছু শূন্য লাগছে ফাঁকা লাগছে' - গঙ্গার তীরের হু হু  হওয়ার শব্দ যেন সেই শূন্যতাকে আরও তীব্র করে তোলে। তেমনই জয়ন্তীর বুকের উপর দাঁড়িয়ে গান গাইতে থাকা বিলু যখন হঠাৎ তার প্রিয়জনদের হারিয়ে ফেলে বিপন্ন বোধ করে, তখনই জয়ন্তীর কুলুকুলু শব্দে তার হৃদয় সুস্থ হয়। ঠিক তখনই, হারিয়ে ফেলা ছোট্টো বিলুকে সে খুঁজে পায়।

যদিও বোধ এবং সদিচ্ছা - দুয়ের নিরিখেই বিগ প্রোডাকশন হাউসগুলির চূড়ান্ত একপেশে অ-পেশাদারিত্ব আজ ইন্ডাস্ট্রিকে অনেকখানি পিছনে ঠেলে দিয়েছে, এ থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের ভরসা রাখতেই হবে প্রতিশ্রুতিমান তরুণ প্রজন্মের প্রতি। ইন্দ্রাশিসের উপর সে কারণেই বাজি ধরা যায়। এখনও পর্যন্ত তাঁর কাজে তিনি একশো শতাংশ সৎ। মধ্যবিত্তের যে-জীবন তিনি অভিজ্ঞতায়, যাপনের মধ্যে পেয়েছেন, জেনেছেন, তাকেই তিনি সাবধানতায় নির্মাণ করেছেন। 'সাবধানতায়' বললাম এই কারনে যে, চারপাশে দেশজুড়ে ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনা - ভোট রাজনীতি, পার্টি ও প্রমোটাররাজ, রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল, ধর্ষণ, ডি-মানিটাইজেশন থেকে জিএসটি, এন আর সি বিরোধী আন্দোলন, জাতপাতের রাজনীতি, মব লিনচিং থেকে দাঙ্গা - তাঁর চরিত্ররা যেন এসব সন্তর্পণে এড়িয়ে বাঁচে। অথচ বাস্তবে এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে আপনি বাঁচতে পারেন না। বাস্তবের রাজনীতি আর শিল্পের নান্দনিকতার মাঝখানে এ যেন এক ব্যালেন্স-এর খেলা, সেফ জ়োন - যার খোলসের ভিতর ঢুকে যাওয়াও এক ধরনের পলায়নবাদ বইকি! ওই চেনা মধ্যবিত্তের গণ্ডি, ওই সেফ জ়োন-এর বাইরে ইন্দ্রাশিস একদিন নিশ্চয় বেরোবেন। প্রকৃত শিল্পী তো তিনিই - যিনি বারবার নিজেকে ভাঙতে চান, অচেনা ক্ষেত্রের ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে যাচাই করেন - সেই ইন্দ্রাশিসকে দেখার অপেক্ষায় কোনো দর্শক দশকের পর দশক অপেক্ষা করতেই পারেন। 

একদা তরুণ মজুমদার হতে চাওয়া আমার সেই সাহিত্যিক বন্ধুটি 'বিলু রাক্ষস' আর 'পিউপা' দেখার পর সেদিন এই কথাগুলিই শুনিয়েছিলেন আমাকে।

Powered by Froala Editor