"এসো প্রাণপণ হাসিমুখে / বলো 'যাও সখা! থাকো সুখে' –" আসা ও যাওয়ার এই দ্বন্দ্বেই সার্থক হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানগুলি। সবশেষে থেকে যায় এক বিরহের আভাস। “এই প্রতীক্ষা তো শুধু সঙ্গিনীর জন্য নয়, প্রতীক্ষা প্রেমের জন্য।” বলছিলেন সঙ্গীতশিল্পী রাহুল মিত্র। কবি পক্ষের এক সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের কথায়, সুরে সেই প্রেমের অনুভূতিটুকু উস্কে দিলেন রাহুলবাবু। পরপর কয়েকদিনের বৃষ্টিতে বৈশাখের দাবদাহও তখন অনেকটা প্রশমিত। রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে হলুদ আলোর নিচে রাহুল মিত্র বিরামহীন গেয়ে চলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান। প্রেমের আহ্বান অনুষ্ঠানের শিরোনাম হিসাবেও কবিগুরুর গান থেকেই বেছে নিয়েছিলেন দুটি শব্দ। ‘এসো প্রাণপণ’।
সহজিয়া সাধকরা বলতেন জাগতিক প্রেম অনিত্য। ঐশ্বরিক যে প্রেম, তাই নিত্য। রবীন্দ্রনাথের নানা রচনাতেও সহজিয়া সাধনার প্রভাব এসেছে। তবে তাঁর প্রেমের ধারণা জাগতিক সীমানা ছাড়িয়ে গেলেও অনিত্য। বা বলা ভালো নিত্য প্রবাহমান। এখানে বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব কাব্যে যেমন শ্রীরাধার অভিসারের পরেই এসে যায় সুদূর প্রবাসের সময়, রবীন্দ্রসঙ্গীতও ‘মিলনের মাঝে বিরহকারায় বাঁধা’। রাহুল মিত্রের এই অনুষ্ঠানের বিষয়টিও ছিল ‘অনিত্য প্রেমে রবীন্দ্রনাথ’।
শিল্পীর সঙ্গীতজীবন সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু করলেন সমীর চট্টোপাধ্যায়। তারপরই অন্ধকার হয়ে যায় মঞ্চ। সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে শোনা যায় এক দীর্ঘ কবিতাপাঠ। এ-দিনের অনুষ্ঠানের জন্যই বিশেষভাবে কবিতাটি লিখেছিলেন রাহুলবাবু। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রেমের যে অস্থিরতাকে তিনি পরবর্তী আড়াই ঘণ্টা ধরে স্পর্শ করলেন, তারই কথামুখ তৈরি করে দিল কবিতাটি। শৈবাল বসুর কণ্ঠে তার উপস্থাপনাও ছিল মনোরম। কবিতাপাঠ শেষ হলে মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে। খোল, তানপুরা, হারমোনিয়ামের সঙ্গতে রাহুল মিত্রের প্রথম আহ্বান শোনা যায় ‘এসো এসো ফিরে এসো’। এরপর একে একে বাছাই করা ২০টি গানে রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রেমের বিস্তারকে ধরতে চান তিনি।
“প্রেম তো একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের যুক্ত হওয়া। কিন্তু সেখানেই যদি থেমে যেতে হয়, তাহলে তো আমরা এই পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বেঁচে থাকতে পারতাম। এই সমাজ, প্রকৃতি কোনোকিছুরই দরকার ছিল না।” বলছিলেন রাহুলবাবু। ব্যক্তি প্রেম থেকে ক্রমান্বয়ে সমাজ ও বিশ্বের সঙ্গে মেলবন্ধনেই প্রেমের সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে সেই কথাটাই বলতে চেয়েছেন তিনি। বোঝাতে চেয়েছেন অনিত্য প্রেমের প্রাসঙ্গিকতাকে।
সার্থক হয়ে উঠতে গেলে প্রেমের বন্ধনকেও আলগা করতে হয়। তাই প্রেমের আহ্বান দিয়ে শুরু হলেও অনুষ্ঠানের মাঝে বেজে ওঠে বিচ্ছেদের সুর। বিরতির পর একে একে রাহুলবাবু গাইতে থাকেন ‘কেন ধরে রাখা’, ‘কাছে যবে ছিলে’, ‘কাছে থেকে দূর রচিলে’-র মতো গান। আবার সবশেষে বৃত্তের মতো ফিরে আসে সেই শুরুর আহ্বান। ‘ফিরে এসো বঁধু হে’ গানের ভিতর দিয়ে এক চিরন্তন প্রতীক্ষার ডাক দিয়ে যান তিনি। এই বিরহই তো কবিগুরুর প্রেম পর্যায়ের গানের মর্মবস্তু। কবিপক্ষের সন্ধ্যায় ‘উৎসাহ উদ্ভাস’-এর এই নিবেদন সেই সুরটাই বুনে দিয়ে গেল।
Powered by Froala Editor