“আমি প্যারিসে থাকতে দেখেছি, সেখানে এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির মানুষদের জন্য প্রায় একটা আলাদা জেলার মতো জায়গা রয়েছে। তাঁরা সেখানে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন।” বলছিলেন প্যারিস প্রবাসী শিল্পী অভিজিৎ ঘোষ। আমাদের দেশে এসব এখনো কষ্ট-কল্পনার বিষয়। এখানে এখনো প্রান্তিক লিঙ্গভুক্ত মানুষরা নানাভাবে ধাক্কা খাচ্ছেন, সমাজের মূলস্রোতে সহজে তাঁদের ঠাঁই হচ্ছে না। কিন্তু সমানাধিকারের দাবি ওঠা থামেনি, এক-অর্থে লড়াই-ই হয়তো। যে-লড়াইতে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ শত্রু নন, বরং আদতে নানা সামাজিক নিয়ম, ঘেরাটোপ আর বিস্মৃতির বিরুদ্ধেই এই যুদ্ধ। এবং যে-যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসই হল সবচাইতে বড়ো অস্ত্র। নিজেকেও এই আবহমান সংস্কৃতি আর ইতিহাসের গভীর অংশ বলে ভাবতে পারার আত্মবিশ্বাস। আর সেই আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা খুঁজতেই রং-তুলি হাতে নিয়েছেন শিল্পী অভিজিৎ ঘোষ। ভারতীয় পুরাণের জগত ছেনে-ছেনে তুলে এনেছেন ভারতের চিরাচরিত সংস্কৃতির মধ্যে থাকা লিঙ্গতারল্যের নমুনাগুলি। আর সেইসব নিয়েই গতকাল এবং আজ মিলে তপসিয়ার টপ-ক্যাট সিসিইউ ক্যাফেতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অভিজিতের চিত্রপ্রদর্শনী ‘পুরাণ ও প্রেম’।
কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘প্রান্তকথা’-র সঙ্গে এই প্রদর্শনীর আয়োজনের যুক্ত ছিল প্যারিসের এলজিবিটিকিউ সেন্টার। সেইসঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অলিয়ঁস ফ্রাঁসে দ্যু বেঙ্গল। প্রান্তকথার প্রতিষ্ঠাতা বাপ্পাদিত্য মুখার্জি জানালেন এই আয়োজনের প্রয়োজনের কথা। “প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের কথা বলতে গেলেই অনেকসময় শুনতে হয়, এগুলো তো ইউরোপ-আমেরিকার ন্যারেটিভ। কিন্তু শুধু পাশ্চাত্যের ন্যারেটিভ নয়, আমাদের দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মধ্যেও যে এই লিঙ্গ তারল্যের শিকড় রয়েছে, সেটাই অভিজিৎ বলতে চেয়েছেন তাঁর ছবির মাধ্যমে।” বলছিলেন বাপ্পাদিত্য। শুধুই প্রদর্শনীর জায়গায় থেমে থাকেনি এই আয়োজন। বরং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের জন্য আর্ট থেরাপির আয়োজন করতে চেয়েছে প্রান্তকথা। বাপ্পাদিত্যের কথায়, “প্রতিদিন সমাজে যেভাবে হিংসার শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষরা, তার বিপরীতে তাঁদের নিজেদের কথা বলার জায়গা তৈরি করে দেওয়া প্রয়োজন।” আর এখানেই শিল্পের প্রয়োজন রয়েছে। সেটা যে কোনো ধরনের শিল্পের ভাষাই হতে পারে। হিংসার উত্তরে ভালোবাসা, হিংসার উত্তরে শিল্পেই বিশ্বাস রাখতে চান বাপ্পাদিত্য।
প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের পৌরাণিক কাহিনির মেলবন্ধনও ঘটিয়েছেন শিল্পী। তাই সেখানে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের দৃশ্যে দেখা যায় তাঁর কোলে সতীর বদলে রয়েছেন যিশু। আবার যিশুর জন্মের সময় প্রাচ্যের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থাকছেন কৃষ্ণ এবং বুদ্ধ। আবার একই ছবিতে মিলেমিশে যান মা দুর্গা এবং মাতা মেরি। অভিজিতের কথায়, “আমি তো ছবি এঁকেছি মূলত পাশ্চাত্যের মানুষকে আমার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করার জন্য। তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে যখন আমি নিজের সংস্কৃতিকে মিলিয়ে দিতে পারবো, তখনই তাঁরা নতুন করে জানার চেষ্টা করবেন।” তবে শুধু এটুকুই নয়। এই সংযোগের পিছনে রয়েছে আরও গভীর তাৎপর্য। বাপ্পাদিত্য বলছিলেন, “এই কাহিনি যে সর্বকালের এবং সব জায়গার, সেটাই এই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে।”
নিজের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, যে জাতির কোনো ইতিহাস নেই তার কোনো ভবিষ্যতও নেই। বিজ্ঞানের যুক্তিতেও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের আত্মপরিচয়ের সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু বাপ্পাদিত্য বলছিলেন, “আমরা যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি ভাবি আবেগ দিয়ে। বিজ্ঞান তো রয়েছেই। কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের ইতিহাসের গল্পগুলোও থেকে যাক।” আর এই ইতিহাসই দুই পৃথক মহাদেশকে একটা সুতোয় বেঁধে দেয়। কারণ দুই মহাদেশের গল্পগুলোও কোথাও গিয়ে একইরকম। দুদিনের এই প্রদর্শনী থেকে আগামী জীবনের জন্য বেশ কিছুটা রসদ সংগ্রহ করতে পারবেন প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষরা। আর সেখানেই এই উদ্যোগের সার্থকতা।
Powered by Froala Editor