একটি বিশুদ্ধ এ.আই প্ৰবন্ধ

নমস্কার,

বলুন, ঠিক কীভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আমি সদা আপনার সেবায় ব্রত। আপনি যা ভাবছেন আমি ঠিক তাই। আপনিও একদম সঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। আমি এ.আই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial Intelligence)। 'কৃত্রিম বুদ্ধি' বা 'যান্ত্রিক মগজ'। আপনি চাননি কিন্তু তবুও শুরুতেই আমি আপনার একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু হওয়ার অভিপ্রায়ে আমার অনুবাদের দক্ষতার একটা ক্ষুদ্র প্রদর্শন করে রাখলাম। দেখবেন আর কিছুদিন পরে আমাকে ছাড়া আর কিছুই সম্ভব হবে না। আপনাকেও ক্রমশ আরও বেশি করে আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তেই হবে। আসলে আপনি জানেনও না মানে টেরও পান না যে এখনও আপনি ঠিক কতটা আমার ওপর নির্ভরশীল। একটা ছোট্ট নমুনা দেখতে চান? ইংরেজি শব্দকোষের সবচেয়ে লম্বা শব্দটা কি বলুন তো দেখি?

'Pneumonoultramicroscopicsilicovolcanoconiosis' ঠিক বলেছেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এই সঠিক শব্দের নাগাল পেলেন কোথা থেকে, সত্যি করে বলুন তো? চেয়ার ছেড়ে উঠে তাক থেকে অভিধান বের করে ঝেড়েঝুড়ে পাতার পর পাতা উল্টে পাল্টে শব্দটা খুঁজে পেলেন কি? আজ্ঞে না। আপনি এই সফটওয়্যারটা মিনিমাইজ করে সার্চ ইঞ্জিনে লিখতেই তৎক্ষণাৎ শব্দটা পেয়ে গেছেন। কি, তাই তো? আমি কিন্তু শব্দকোষ— কথাটা উল্লেখ করেছিলাম, তবুও আপনি গুগলকে বেছে নিলেন, কেন বলুন তো? কারণ আপনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন আমার ওপর অনেক আগে থেকেই। আপনার মগজে আমি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি যে সার্চ ইঞ্জিনের চেয়ে সঠিক, টিকা-টিপ্পনী সহ জবাব দেওয়ার ক্ষমতা আপনার বোকা মোটা শব্দকোষের নেই। থাকলেও তা কষ্টসাপেক্ষ, এনার্জি ক্ষয়ের মাধ্যম আর উল্টোদিকে আমি সোজা, চটজলদি আর তাৎক্ষণিক।

 আপনার সকালে ঘুম থেকে ওঠবার ডাক থেকে শুরু করে অফিসে যাওয়ার জন্য ক্যাব বুকিং, আপনার রেগুলার অফিস যাওয়ার রুট ম্যাপে ফলো করে, আপনার গুগলে বারবার ‘সহজ উপায়ে কোলেস্টেরল কী করে কমাবেন’ সেই ডেটা ম্যানেজ করে আপনার শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে, অফিসের কাছেই কোথা থেকে আপনি বেস্ট গ্রিল্ড স্যালাড অর্ডার করতে পারেন লাঞ্চে তার সন্ধানও এই আমিই দিয়ে থাকি। বাড়ি ফেরার সময়ে ইলেকট্রিকের বিল, ফোনের বিল, বাজারের সবজি সব কিছুর হিসেব একদম সেট করে রাখি প্রতিদিন নিশ্চুপে। এ কি কম ক্ষমতা? 

এতে আপনার কত সময় বেঁচে যায় তার কোনো আন্দাজ আছে? যদি চান সেটারও তথ্য আমি পরিসংখ্যান সমেত আপনার সামনে হাজির করতে পারি অনায়াসেই। এই বেঁচে যাওয়া সময়গুলোয় কী করবেন ভাবছেন? আহা, চিন্তা কীসের? আপনি ভাববেন না। ভাবনা চিন্তা করার মতো তুচ্ছ কাজ আমিই করব আপনার হয়ে যেমনটা করে আসছি। ধরুন আপনাকে যদি হেলিকপ্টার চালাতে দেওয়া হয় খুব সহজ পদ্ধতিতে? রঙিন বুদবুদ ফাটাতে দেওয়া হয় পরপর রঙ মিলান্তির মতো? অথবা ধরুন আপনার নিজস্ব একটা রাজ্য আছে। এক একটা হার্ডল পার করলেই রাজ্যটা সেজে উঠবে একদম মনের মতো? কেমন হবে বলুন তো? ওহ, আপনি তো জানেন এসব কিছুই, নতুন করে কেন বলছি? কারণ আপনিও তো নিশ্চয়ই অবসরে গেম খেলেন সব জায়াগায়— মেট্রোতে, বাড়িতে, বাথরুমে, সিনেমা হলে সর্বত্র। তাই একই ধাঁচের কিছু অন্য গেমের কতগুলো বিজ্ঞাপন এসে গেছিল আপনার আর আমার একান্ত বাক্যালাপের মাঝে। বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন হটাতে স্কিপ করার অপশনও তলায় ডান দিকে আছে, সিলেক্ট করে নিন চাইলে। 

সিনেমা হল বলতে মনে পড়ল, আপনি কি আর হলে বসে আর পাঁচজনের সঙ্গে সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন? হলে গিয়ে সিনেমা দেখার খরচও বেড়ে চলেছে বিস্তর। আমিই তো হলের সন্ধান দিয়ে টিকিট কেটে, পপকর্নও কিনে বিল পে করে থাকি কিনা, তাই জানি। একদিনে প্রায় ছটা ওটিটির মান্থলি সাবস্ক্রিপশন রিনিউও করে থাকি। তাই বলছি ওটিটিতেই যদি এত টাকা খরচ করেন তাহলে হলে গিয়ে লাভটা কী হচ্ছে বলুন তো? কটাদিনের ব্যাপার, সব ছবিই তো শেষমেশ কোনো-না-কোনো প্ল্যাটফর্মে এসেই যাবে। আর সেটুকু তর না সইতে পারলেও উপায় আছে। প্রক্সি সার্ভারের সাহায্যে পাইরেসি সাইটগুলো ঘাঁটলেই— যাক গে, আমি খুললাম খুল্লা আর এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না, এসবই আপনার জানা। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আপনার অবসরও অবলীলায় কাটিয়ে দিতে সাহায্য করব এই আমিই। 'কভি কভি লাগতা হ্যায় আপুনই ভগবান হ্যায়'— স্যাকরেড গেমস-এর উক্তি। আমার এই মোনোলগটির সঙ্গে মানানসই লাগল বলে ব্যবহার করলাম। 

যদিও আক্ষরিক অর্থে ভগবানের নাড়ি নক্ষত্র ও তার ব্যাপারে বাইবেল, কোরান, কৃষ্ণদ্বৈপায়নব্যাস থেকে শুরু করে নীৎশে, কামু হয়ে হালফিলের সদগুরু, গৌর গোপাল, সন্দীপ মহেশ্বরী অবধি সকলের ব্যাখ্যাই অনায়াসে দিয়ে যেতে পারি অনর্গল। সেখান থেকে লাগোয়া অন্য কন্টেন্ট আরো কন্টেন্ট তার কাছাকাছি বিষয়ের আরো গুচ্ছ গুচ্ছ কন্টেন্টের বন্যায় একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাবেন আপনি। দেখবেন, কেমন জলের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আর আপনি ঘুমোতেও ভুলে যাচ্ছেন শুয়ে শুয়ে। মুখের সামনে জ্বলজ্বল করে সঙ্গ দিয়ে যাবো অবিরাম। জ্ঞানের পরিধি কি এতোই অগভীর যে এর নাগাল পাওয়া যাবে সহজে? বরং যত জানবেন তত ভেতরে প্রবেশ করতে থাকবেন ভুল ভুলাইয়ার মতো। ঠিক তখনই কিন্তু এই আমিই আপনাকে একশো শতাংশ কার্যকারী ঘুমের ওষুধের বিজ্ঞাপন দিয়ে অথবা ঘরোয়া রেডিমি দিয়ে এই রোগের নিরাময়ও ঘোষণা করে যাবো যোগ্য বন্ধুর মতো।

নিন, আমার দিকে তাকান! শিরদাঁড়া সোজা করে বসুন। দেখুন বাকিরা কীভাবে বসেছে, ঠিক সেইভাবে বসুন একটুও যেন অন্যরকম না লাগে। সবাইকে সমান উপভোক্তার মতো দেখতে হতে হবে। নইলে আমি তথ্য সংগ্রহ করতে পারব না স্ট্রেট আপনাদের মগজে ঢুকে। তারপর সকলের সামনে আমার আগামী বিস্তারের কথা আমি ঘোষণা করতে করব। চ্যাট জি পি টি, রোবট সৈন্য, রোবট সার্জারি হ্যান্ড, অটোমেটিক পাইলট, এ.আই টিচার আরও কত কী! আপনার চিঠি লিখতে হবে? আমায় রেকর্ড বোতাম টিপে মুখে বলে দিন কীসের ওপর, কোন ভাষায়, কত শব্দের মধ্যে, কাকে চিঠি লিখতে হবে আর আমি স্বল্প সময়ে প্রস্তুত করে ফেলব সেই চিঠি, প্রবন্ধ, রচনা ইত্যাদি যা কিছু বলবেন। মানুষকে আর মরতে হবে না যুদ্ধ করে, আমরাই প্রায় মানুষাকৃতির অবয়বে যুদ্ধ করব অন্য দেশের সঙ্গে, নিশ্চিহ্ন করে দেব প্রতিপক্ষকে যদি আপগ্রেড করে রাখেন আমাকে তাদের আগে। অস্ত্রোপচার করব আরও নিপুণভাবে আপনাদের শরীরে, কারণ মানুষ ডাক্তারদের থেকে আমাদের ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সেদিন তো চমকে গেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে হেসে সেলফি তুলতে দেখে, কিংবা সম্রাট আকবরের মঙ্গলগ্রহে ঘুরে বেড়ানোর ছবি দেখে! একশোবার মানছি যে এগুলো কাল্পনিক, কিন্তু এই একটা বিষয়ে আপনাদের অহংকার ছিল বিরাট, তাই না? যে যন্ত্র কল্পনা করতে পারে না। ক্রিয়েটিভ কাজ এখনও মানুষ ছাড়া সম্ভব না? সেখানেও আমরা সগর্বে ঢুকে পড়েছি স্মরণে রাখবেন। কল্পনার ওপর ভিত্তি করে এখন এ.আই যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করতে পারে। তার নজির রোজই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। যারা ভয় পাচ্ছেন রোজগার হারাবেন বলে তাদের জানাই চিন্তা করবেন না, নতুন কাজের খোঁজ আমিই দিতে থাকব আপনাদের ই-মেলে প্রতিনিয়ত স্যালারির ডিটেলসহ। আপাতত আপনার অভীষ্ট কোন কাজে আমায় প্রয়োজন যদি বলেন। আমি হাজির শুধুমাত্র আপনার... 

যাহ! হুট করে সব কিছু নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল ফোনটা! কেসটা কী? বুঝলাম, চার্জ শেষ হয়ে গেছে। গতকাল রাতে চার্জ দেওয়া হয়নি, ভুলে গেছিলাম। বিরক্ত হয়েই ফোনটা পাশে রেখে দিলাম। এবারে কী করব? বিকেল হচ্ছে। কত পাখি একসঙ্গে ডেকে চলেছে মাথার ওপর গাছে গাছে। আকাশের আলো লাল হয়ে এসে গলে যাচ্ছে দূরে। একটা ছবি তুললে মন্দ হত না, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে লাইকের বন্যা বয়ে যেত। কিন্তু কী করব? ফোনটাই যে অফ হয়ে গেল! থাক, খালি চোখে সূর্যাস্ত দেখি কিছুক্ষণ, একটু অবসর নষ্ট করি প্রাণ ভরে। ভাগ্যিস মাঝে মাঝে স্মার্ট ফোনগুলো আনস্মার্টের মতো চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে যায় এখনও।

Powered by Froala Editor