মানবসভ্যতা যত উন্নতির পথে এগিয়েছে, ততই বিপদের মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। কিছুতেই যেন রক্ষা নেই এই সমস্যা থেকে। শিল্প বা খনিজ সম্পদের জন্য নির্বিচারে অরণ্যভূমি ধ্বংসের ফলে বিলুপ্তির মুখে অসংখ্য প্রজাতির পশু-পাখি। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে গত শতাব্দীতে কয়েক হাজার প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। তবু যেন শিক্ষা নেয়নি মানুষ। যার সঙ্গে সাম্প্রতিক সংযোজন বিশ্ব উষ্ণায়ন। আর যে কারণে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অবলুপ্ত হয়ে চলেছে উভচর (Amphibian) প্রাণীরা।
‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অফ ন্যাচার স্পিসিস’-এর (IUCN) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে এই বিপদের আশঙ্কা। ২০০৪ সাল থেকে যারা ধারাবাহিকভাবে নজর রেখে এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিলুপ্তপ্রায় পশু-পাখিদের উপরে। বাসস্থানের অভাব ও নিত্যনতুন রোগের কারণে গত কুড়ি বছরে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে উভচর প্রাণীকূল। কিন্তু বর্তমান উষ্ণায়নের জেরে তাঁদের অস্তিত্ব এত দ্রুত লোপ পেতে শুরু করেছে যে, বিজ্ঞানীরা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাদেরকে উদ্ধার করে, গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের যে ইঙ্গিত দেওয়া সম্ভব, সেই সময়ও মিলছে না। বিজ্ঞানীদের অনুমান, উষ্ণায়নের কারণে বিরল প্রজাতির উভচর প্রাণীদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্যদিকে খাদ্য-বাসস্থানের অভাবে ৩৯ শতাংশ উভচর বিপদের মুখে। ৮০১১টি প্রজাতির প্রাণীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ২৮৭৩টি প্রজাতি একেবারে অবলুপ্তির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ৩০০ প্রজাতির উভচর প্রাণী সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। যেখানে গত শতকের শেষ দশকে বিলুপ্ত প্রাণীর সংখ্যা ছিল ২৬। অর্থাৎ অতি দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে অবলুপ্তির হার। এর সঙ্গে কীভাবে যুক্ত বিশ্ব উষ্ণায়ন? গবেষকরা জানাচ্ছেন, উভচরদের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল জল। সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্ম। আর্দ্র ত্বককে তারা ব্যবহার করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়ক অঙ্গ হিসেবে। এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল তাদের চরিত্র। কিন্তু উষ্ণায়নের কারণে অনেক স্থানেই ঘাটতি দেখা দিচ্ছে জলের। কোথাও বা তপ্ত আবহাওয়া বাদ সাধছে স্বাভাবিক জননপ্রক্রিয়া। এর সঙ্গে বাতাসে দূষিত পদার্থের বাড়বাড়ন্ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাদের।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে ব্রাজিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য। গত কয়েক দশক ধরেই আমাজন অববাহিকায় যেন অরণ্য ধ্বংসের প্রতিযোগিতা চলছে। এবছর তীব্র খরা চলছে সেই অঞ্চলে। জলস্তর এতটাই উত্তপ্ত হয়ে গেছে যে, বহু দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে ইতিমধ্যেই। অথচ এই অরণ্যকে ধরে নেওয়া হয় পৃথিবীর ফুসফুস রূপে। ১২০০ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বৈচিত্র্য সারা বিশ্বে আর কোথাও দেখা যাবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা ১৮৯টি প্রজাতির অবস্থাকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য গোলাপি ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার, আমাজনে অব্যাহত মৃত্যুমিছিল
অবস্থা কতটা খারাপ, সেটা বোঝাতে নিয়ে আসা হয়েছে ‘দ্য তেতেকুয়েম ফ্রগ’-এর প্রসঙ্গ। সোনালি শরীরের এই ব্যাঙগুলির দেখা পাওয়া যেত একমাত্র ব্রাজিলেই। তবে এখন আর তা সম্ভব নয়। একুশ শতাব্দীতে ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকায় এই ব্যাঙের খোঁজ মেলেনি। একই উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ‘লিটল ওয়ার্টি ফ্রগ’ ও ‘দ্য পেট্রোপলিশ স্টোন ফ্রগ’-এর ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয় ব্যাঙটিকে তো শেষবার দেখা গেছিল ১৯৮২ সালে। আর শুধু ব্যাঙ নয়, সাপ, গোসাপের মতো প্রাণীরাও বর্তমানে বিপদগ্রস্ত।
আরও পড়ুন
উষ্ণায়নের ফলে হারাতে বসেছে ‘এমপেরর’-রা, মৃত্যুর মুখে কয়েক হাজার নবজাতক
গত চল্লিশ বছরের মধ্যে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে আমাজনে। অন্যদিকে কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টি কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। খরা হয়ে গেছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। একটা সময় পর্যন্ত অনুমান করা হত যে, আর্দ্রতা ও জলের অভাবে মাটির কাছাকাছি থাকা প্রাণীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা সম্পূর্ণরূপে খারিজ করে দিচ্ছে এই সম্ভাবনা। দেখা গেছে ১৬০০ মিটার উঁচু ব্রাজিলের রোরাইমা পাহাড়ের ‘ট্রি ফ্রগ’-রাও বিলুপ্তির ভবিতব্যের সঙ্গে লড়াই করছে।
একটা বিষয়ে কিন্তু বারবার সচেতন করছেন ‘আইইউসিএন’-এর বিজ্ঞানীরা। এই উভচর প্রাণীরা বহুভাবে সংযুক্ত প্রকৃতির ভারসাম্যের সঙ্গে। শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় তারা। বরং খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় গ্রহণ করে অনেক দুরারোগ্য রোগ থেকে মানবপ্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে এরা। ফলে এদের অবলুপ্তিতে ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগ আবার ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, আশঙ্কায় গবেষকরা। কিন্তু সমাধানের পথ কী? বিশ্ব উষ্ণায়ন ও দূষণের মতো সমস্যার মোকাবিলা না করতে পারলে, অনিবার্য হয়ে যাবে এই সকল উভচর প্রাণীদের অবলুপ্তি। তাতে কি ঘুম ভাঙবে সংশ্লিষ্ট মহলের? বন্ধ হবে নির্বাচারে অরণ্যধ্বংস? আপাতত নিরুত্তর সকলেই।
Powered by Froala Editor