কলকাতার মার্কিন সেনা, ‘নরখাদক’ কৃষ্ণাঙ্গ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলি

চল্লিশের দশকের শুরুর দিক। বিশ্বযুদ্ধের আঁচে একটু একটু করে তপ্ত হচ্ছে বাংলা। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা। কারণ, তখনও ব্রিটিশ রাজত্বের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই শহর। ফলে, অবস্থানগত এবং কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য কলকাতাই অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল জাপানের। রাত-দিন সেসময় কলকাতার আকাশে উড়ে বেড়াত জাপানি ফাইটার জেট। ব্রিটিশ শাসকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে শুরু হল মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ। প্রাণও হারালেন জনা পঞ্চাশেক মানুষ। একদিকে যখন জাপানের এই আগ্রাসী মেজাজে কাঁপছে কলকাতা, তখন অন্যদিকে ইম্ফল, সিঙ্গাপুর নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর দখলে। সেখানেও তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন সেই জাপানিরাই।

’৪২-এর এই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থা যে মোটেই সুবিধার ছিল না, তা ভালোই বুঝেছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। ফলত, জাপানকে ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হন চার্চিল। আর সেই সূত্রেই ’৪২-এর মাঝামাঝি সময়েই কলকাতা বন্দরে প্রথম পা রাখে মার্কিন সেনাদের দল। সব মিলিয়ে ভারতের পরিস্থিতি সামাল দিতে সেসময় পাঠানো হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ মার্কিন সেনা। শুধু কলকাতাই নয়, কলকাতার নিকটবর্তী নদীয়া জেলার ৪৬টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক আস্ত মার্কিন উপনিবেশ। রুজভেল্ট নগরী। আর সেই মার্কিন ঘাঁটির নকশা সাজিয়েছিলেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একাধিক বেস ক্যাম্প, অস্থায়ী সেনা বিমানবন্দর, রানওয়ে। তবে ব্রিটিশ সরকারের শর্ত ছিল একটাই। ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং রাজনীতিতে যেন কোনোরকম অংশ না নেয় মার্কিনিরা। মার্কিন সেনাদের কলকাতার সম্পর্কে অবগত করতে সেসময় একাধিক পকেট পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশরা। ‘দ্য ক্যালকাটা কি’ নামের এমন একটি পুস্তিকাতেই স্পষ্ট করে মোটা হরফে উল্লেখিত হয়েছিল সেই সাবধানবাণী।

তবে, এসব সাবধানবাণীর পরেও শেষ অবধি ভারতের সঙ্গে বেশ ভালোমতোই জড়িয়ে পড়েছিলেন মার্কিন সেনারা। আর তা হবে না-ই বা কেন? ততদিন পর্যন্ত কলকাতা বলতে তাঁদের চোখের সামনে ছিল কেবলমাত্র কিছু হলিউডি সিনেমার দৃশ্যবিশেষ। কলকাতা বলতে ঘোড়ায় টানা গাড়ি, ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদ আর সাজানো গোছানো সম্ভ্রান্ত কিছু পরিবার— এই ছবিই ধরা পড়েছিল সেসব চলচ্চিত্রে। কলকাতা বন্দরে নামার পরই সেই ভুল ভাঙে মার্কিনিদের। যে ‘স্বাধীনতা’ রক্ষার স্বার্থে পাঠানো হয়েছে তাঁদের, সেই স্বাধীনতার জন্যই বিপ্লবের আগুন জ্বলছে গোটা দেশজুড়ে। সেইসঙ্গে গোটা বাংলায় হাহাকার দু’মুঠো খাবারের জন্য। গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে মানুষের মৃতদেহ। 

সেসময় কলকাতার মেয়র সৈয়দ বদরুজা স্বয়ং খাদ্যসাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টকে। কিন্তু ব্রিটেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। কিন্তু ওপর মহল থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও, চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি মার্কিন সেনারা। বরং, তাঁরা নিজেদের রেশনের বরাদ্দ খাবারের একাংশ তুলে দিতেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের হাতে। কলকাতা তথা বাংলার একাধিক জায়গায় গড়ে উঠেছিল মার্কিন ত্রাণকেন্দ্র। এমনকি মার্কিন সেনাদের বিনোদনের জন্য খোদ কলকাতার বুকে বসেছিল দু’দুটি কোকাকোলা, চকোলেট এবং আইসক্রিমের কারখানা। উভয়ক্ষেত্রেই প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে পাস পেতেন মার্কিন সেনানীরা। সেই পাসও অনেক সময়ই স্থানীয় কচিকাচাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তাঁরা। এসবে বাইরে কলকাতা ময়দানে হামেশাই বাঙালিদের সঙ্গে ক্রীড়াযুদ্ধেও অবতীর্ণ হতে দেখা যেত তাঁদের। 

আরও পড়ুন
শত্রুপক্ষকে একা হাতে সামলে বিশ্বযুদ্ধের 'নায়ক' এই পর্তুগিজ সৈন্যই

তবে আমজনতার সঙ্গে মার্কিন সেনানীদের এই মিত্রতা খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি ব্রিটিশ সরকার। বরং, দুর্ভিক্ষে মার্কিন সেনাদের হস্তাক্ষেপকে রাজনৈতিক চাল হিসাবেই দেখা হয়েছিল সেসময়। বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে কলকাতায় মার্কিন সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার হিন্দুস্তান বিল্ডিং-এ গোপনে গোয়ান্দাও মোতায়েন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে মার্কিনিদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ছড়ানো হয়েছিল ভুয়ো তথ্যও। রাতারাতি সমাজের একটা বড়ো অংশে রটে গিয়েছিল, কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সেনারা নরখাদক। মানুষের মাংসেই পেট চলে তাঁদের। যার ফলাফল হয়েছিল মারাত্মক। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে কলকাতার বুকেই ঘটে গিয়েছিল ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ হত্যাকাণ্ড। বিক্ষিপ্তভাবে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় প্রাণ গিয়েছিল ২৬ জন মার্কিন নাগরিকের। যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়েই প্যারালিম্পিকের পরিকল্পনা, আয়োজনে এক চিকিৎসক!

যদিও ‘ক্যালকাটা কিলিং’-এর আগে থেকেই ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্ণবাদের বিষ ছড়িয়ে পড়ার পর, সেই প্রক্রিয়ায় গতি বাড়ে আরও। ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে রুজভেল্ট নগরী। বাংলার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র সেনা ছাউনি। পরবর্তীতে বিধানচন্দ্রের হাত ধরে রুজভেল্ট নগরীর নয়াজন্ম হয় ‘কল্যাণী’ নামে। কল্যাণী বাদ দিলে গোটা বাংলার বুকে আজও পরিত্যক্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মার্কিন রাজত্বের ছাপ। যার মধ্যে অন্যতম বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গলের পরিত্যক্ত অস্থায়ী মার্কিন বিমানবন্দর। 

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী ভালুক, ধরিয়ে দিয়েছিল গুপ্তচরকেও!

এ তো গেল বাংলার ভৌগলিক পরিস্থিতির রদবদল। এটুকু বাদ দিলে মাত্র পাঁচ বছরের মার্কিন ‘ঔপনিবেশিকতা’-র প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল বাঙালির জীবনেও। কোকাকোলা’র মতো পানীয়ের প্রচলন যে মার্কিনিদের হাত ধরে, তা তো উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। সেইসঙ্গে তাঁদের ব্যবহৃত ক্যানড ফুড-ও জনপ্রিয়তা পায় কলকাতা শহরে। কলকাতার সিনেমা হলগুলিতেও নতুন করে রাজত্ব শুরু হয় হলিউডের। পার্ক স্ট্রিটে শুরু হয় জ্যাজ-যুগ। অবশ্য বাংলার সামাজিক বিবর্তনে মার্কিনিদের এই ভূমিকা মনে রাখেনি কেউ-ই। ইতিহাস পাঠ্যবইও তাঁদের অবদান উপেক্ষা করে গেছে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই। শুধু প্রামাণ্য হিসাবে রয়ে গেছে ঐতিহাসিক তপন চৌধুরীর হাতে গোনা কয়েকটি বই, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের লেখা কিছু প্রবন্ধ এবং তৎকালীন সংবাদপত্রের খণ্ডচিত্র। সেটুকুরই বা খোঁজ রেখেছে ক’জন?

তথ্যসূত্রঃ
১. When US soldiers got caught in the traffic of Calcutta, The Indian Express
২. Coca-Cola, canned food and Jazz nights: What American GIs brought to the streets of Calcutta during WWII, Adrija Roychowdhury, The Indian Express
৩. The Bengal famine of 1943 and the American insensitiveness to food aid, Manish Sinha 

Powered by Froala Editor

More From Author See More