বৃহস্পতিবার যেন গমগম করছিল কানেক্টিকাটের রক্সবারির মিউজিক্যাল হাউস। হ্যাঁ, এই বাড়ি কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালক স্টিফেন সন্ডহাইমের। গত পরশুদিন খ্যাতনামা বাদ্যকার ও সঙ্গীতশিল্পীদের মহড়া পড়ে গিয়েছিল সে-বাড়িতে। প্রিয় বন্ধুবান্ধব, নিকটজন এবং সহশিল্পীদের বাড়িতে নিজেই আমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, ধন্যবাদজ্ঞাপন। তার মাত্র একদিনের মধ্যেই সমস্ত উদযাপনের আলো নিভে যাবে, কেই বা জানত? গত শুক্রবার ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি মার্কিন সুরকার। না, আত্মহত্যা নয়। স্বাভাবিক মৃত্যুই। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন।
তবে শুধু সঙ্গীতশিল্পী বললে বোধ হয় সঠিক পরিচয় দেওয়া হয় সন্ডহাইমের। মিউজিক্যাল থিয়েটার তথা গোটা বিনোদন দুনিয়ার ছবিটাই বদলে দিয়েছিলেন সন্ডহাইম। তৈরি করেছিলেন ল্যান্ডমার্ক।
কিশোর বয়সেই তাঁর শরীরে যেন গেঁথে গিয়েছিল থিয়েটারের প্রতি এই ভালোবাসা। বছর নয়েক বয়স তখন সন্ডহাইমের। প্রথমবার বাবা-মায়ের সঙ্গে ব্রডওয়েতে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন সন্ডহাইম। ‘দ্য কিং অ্যান্ড আই’ মিউজিক্যালের প্রদর্শনী ছিল সেদিন। গানের তালে দৃশ্যে অপরূপ মেলবন্ধনের মাদকতার স্বাদ পাওয়া সেই। অলক্ষ্যেই যেন তাঁর আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন এই মিউজিক্যালের স্রষ্টা, সুরকার তথা লিরিসিস্ট অস্কার হ্যামারস্টাইন।
বছর খানেক হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পর পর ব্রডওয়ে-তেই হ্যামারস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সন্ডহাইমের। ভাগ্যই যেন এক কিংবদন্তিকে মিলিয়ে দিয়েছিল আরেক ভবিষ্যৎ কিংবদন্তির সঙ্গে। হ্যামারস্টাইনের সঙ্গীতেই অনুপ্রাণিত হয়ে বছর বারো বয়সে প্রথম সঙ্গীতরচনা করেন সন্ডহাইম। ধীরে ধীরে আরও গভীর হয় দুই কিংবদন্তির সম্পর্ক। কিশোর ভক্তের গানে বিভিন্ন পরিবর্তনের পরামর্শও দিতেন হ্যামারস্টাইন। গানের পরিকাঠামো নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। পেশাগত সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ তারও বেশ কয়েক বছর পর।
আরও পড়ুন
এসডি বর্মণ এবং আরডি বর্মণের বাড়িতেই সঙ্গীত মিউজিয়াম, উদ্যোগ কলকাতা পুরসভার
পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক সেটা। জুলিয়াস এবং ফিলিপ এপস্টিনের লেখা একটি নাটককে মিউজিক্যালে বদলে ফেলার কমিশন পান সন্ডহাইম। আক্ষরিক অর্থে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক কাজ। ফলাফল, ‘স্যাটারডে নাইটস’-এর মতো মাস্টারপিস। ১৯৫৪ সালে সেই মিউজিক্যাল মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও, প্রযোজকের মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় তার মঞ্চায়ন। ৪৩ বছর পর ১৯৯৭ সালে লন্ডনে মুক্তি পেয়েছিল সেই নাটক।
আরও পড়ুন
হতে পারতেন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পীও; ভালোবেসেই সন্তুষ্ট বুদ্ধদেব
বিনোদনের জগতে তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় ১৯৫৭ সালের ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’। ব্রডওয়ে থিয়েটারে সেটাই প্রথম কাজ ছিল সন্ডহাইমের। রোমিও জুলিয়েটের ওপর তৈরি এই মিউজিক্যাল ড্রামার ৭০০টিরও বেশি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ব্রডওয়েতে। এই বিপুল সাফল্যের পর ১৯৬১ সালে সন্ডহাইমের এই মিউজিক্যালকে সিনেমার রূপ দেন পরিচালক জেরোমি রবিনস এবং রবার্ট ওয়াইস। বলাইবাহুল্য, সেই চলচ্চিত্রও বক্স অফিস কাঁপিয়েছিল। পকেটে পুরেছিল দশ দশটি অস্কার। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন
ভাঙচুর জাতীয় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানে, তালিবান রাজত্বে আবারও কোপ সঙ্গীতচর্চায়?
পরবর্তী ছ’দশক নাটক এবং মিউজিক্যালের ধারণাই বদলে দিয়েছিলেন সন্ডহাইম। তাঁর হাত ধরেই ‘এ লিটল নাইট’, ‘কোম্পানি’, ‘ফলিস’-এর মতো মাস্টারপিস পেয়েছেন বিনোদনজগত। সঙ্গীত পরিচালনা ছাড়াও কথা লিখেছেন ‘সেন্ড ইন দ্য ক্লাউনস’, ‘এ লিটল নাইট’-এর মতো ব্রডওয়ের নাটকে। বিশেষত তাঁর লেখা ‘এ লিটল নাইট’ নাটকটি একেক পরিচালকের হাত ধরে পুনর্নির্মাণ হয়েছে শতাধিকবার। এই উদাহরণ থিয়েটারের দুনিয়ায় বিরল বললেই চলে।
অস্কার তো বটেই, সন্ডহাইমের ঝুলিতে রয়েছে আটটি গ্র্যামি এবং ন’টি টনি পুরস্কার, লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অফ থিয়েটার-সহ একাধিক পুরস্কার। সেই দীর্ঘ তালিকা শেষ হওয়ার নয়। ২০১৫ সালে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’-ও প্রদান করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বারাক ওবামা। তাছাড়াও চলতি শতকে ব্রডওয়ে এবং লন্ডনের কুইন্স থিয়েটারের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থতার জন্য বিনোদনের মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেও তিনি যেন অভিভাবক ছিলেন মার্কিন সঙ্গীতের। তাঁর প্রয়াণে মিউজিক্যালের মাথা থেকে সরে গেল সেই ছাদটাই…
Powered by Froala Editor