১৯০২ সাল, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল এক হাড় হিম করা প্রতিবেদন। ব্রিস্টল শহরের কাছে নতুন বাড়ি কিনেছেন এক ভদ্রলোক। পুরনো বাড়িকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার পর হাত দিলেন বাগান তৈরির কাজে। মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন। আর মাটি খুঁড়তে গিয়ে যা পেলেন, তাতে স্তম্ভিত তিনি। প্রায় ৫টি শিশুর মৃতদেহ। তাদের প্রত্যেকের শরীর সাদা ফিতে দিয়ে বাঁধা। দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থাকার জন্য হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ খবর দিলেন স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। তাঁরা বর্ণনা শুনেই অবশ্য বুঝতে পারলেন, এই বাড়িই কুখ্যাত অ্যামেলিয়া এলিজাবেথ ডায়ারের বাসগৃহ।
আরও পড়ুন
শিশুর মতো মুখ, একাধিক খুন-ডাকাতির সঙ্গে জড়িত এই ব্যক্তি
কে এই এলিজাবেথ ডায়ার? তাঁর বাড়ির মাটিতে ৫টি শিশুর মৃতদেহ কেন? সেই ইতিহাস উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের এক মর্মান্তিক ইতিহাস। ৫টি নয়, সারাজীবনে অন্তত ৪০০ শিশুকে হত্যা করেছেন এলিজাবেথ ডায়ার। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে একের পর এক হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দুর্ধর্ষ মহিলা সিরিয়াল কিলার খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এলিজাবেথ ডায়ারের জন্ম ১৮৩৭ বা ১৮৩৮ সালে ব্রিস্টল শহরে। বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র চর্মকার। জুতোর কারিগর হিসাবে সামান্য সুনাম ছিল তাঁর। রোজগার খুব বেশি ছিল না, তবে সংসারে অভাবও ছিল না তেমন। অ্যামেলিয়ার পরেও আরও দুই বোনের জন্ম হয়। কিন্তু তারা বেশিদিন বাঁচেনি। অতএব অ্যামেলিয়াই পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য। মোটামুটি আদরেই দিন কাটত। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার অনুসন্ধানও করতে হল। কাজ নিলেন একটি স্থানীয় গার্মেন্টের দোকানে। কিন্তু হঠাৎ কী হল, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন অ্যামেলিয়া। তখন ১৮৫৯ সাল। ২২ বছরের অ্যামেলিয়া বিবাহ করলেন রীতিমতো বৃদ্ধ এক ব্যক্তিকে। জর্জ থমাস নামের সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিবাহের পর এক কন্যাসন্তানের জন্মও দিলেন। কিছুটা রোজগারের আশায় নার্সিং ট্রেনিংও নিলেন। আর তখনই তিনি পেলেন একটা অন্যরকম জীবিকার সন্ধান। বেবি ফার্মিং।
আরও পড়ুন
এখনও সংরক্ষিত আছে স্পেনের এই সিরিয়াল কিলারের মাথা
বেবি ফার্মিং বিষয়টা অনেকের অজানা ঠেকতে পারে। তবে উনিশ শতকের ইউরোপে এই জীবিকা বেশ জনপ্রিয় ছিল। অবিবাহিত অনেক মহিলাই কোনো কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তেন। অথচ ভিক্টোরিয় রীতিতে একক মাতৃত্ব ছিল রীতিমতো পাপ। সেই মহিলা তখন নবজাত সন্তানকে দত্তক দিতেন। সঙ্গে শিশুর পরিচর্যার জন্য কিছু অর্থ। পুরোটাই এমন গোপনে করতে হত যে, এরপর আর সেই শিশুর কোনো খবরই রাখতে পারতেন না তাঁর মা। আর বিমাতার কাছে অনাদরে অযত্নে বেড়ে উঠত শিশুটি। অনেক সময় অপুষ্টির কারণে মারাও যেত। এলিজাবেথ ডায়ারের কাছেও প্রথম প্রথম কয়েকজন শিশু অপুষ্টির কারণেই মারা যায়। কিন্তু ক্রমশ পরিস্থিতি এমন হয়, শিশুদের মৃত্যুই যেন তাঁকে নেশার মতো ঘিরে ধরে। সেটা কি কোনো মনোবিকলনের লক্ষণ? কী জানি! হয়তো হবে তাই। তবে তখন মনস্তত্ত্ব নিয়ে এতো গবেষণার সুযোগ ছিল না। তাই আপাতত এলিজাবেথ ডায়ারকে আমরা কেবল একজন অপরাধী হিসাবেই চিহ্নিত করতে পারি।
আরও পড়ুন
১২০ বছর আগে আত্মহত্যা ইঞ্জিনিয়ারের, এখনও টের পাওয়া যায় ‘অশরীরী’ অস্তিত্ব!
প্রথম প্রথম শিশুদের ফেলে রাখতেন হাত পা বেঁধে। খাবার বলতে কিছুই দিতেন না। কান্না থামাতে তাদের মুখে ঢেলে দিতেন আফিমের একটি জনপ্রিয় মিশ্রণ, গডফ্রে'জ কর্ডিয়াল। এভাবেই ক্রমশ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ত নিরপরাধ শিশুরা। তারপর ডাক্তার এসে তাদের পরীক্ষা করে জানত, শিশুটি মারা গিয়েছে। অপুষ্টি তখন ইংল্যান্ডে রীতিমতো মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ফলে সহজে সন্দেহ হত না কারোর। তবে কখনও কোনো ডাক্তারের সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে কাজ শুরু করতেন এলিজাবেথ ডায়ার।
আরও পড়ুন
ছদ্মবেশে তুখোড়, হাজারো রহস্য ভেদ করা ভারতের প্রথম মহিলা গোয়েন্দার গল্প
এর মধ্যে ধরাও পড়েছেন। ১৮৭৯ সালে একটি মামলায় ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর আবার নিজের কাজ শুরু করেন। এবার আর ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করেন না। মৃত্যুর পর সেই শিশুকে ফেলে দেন টেমসের জলে। আর শিশুদের মেরে ফেলতেও বেশি সময় নিতেন না তিনি। গলায় ফিতে বেঁধে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে লাগলেন। তবে এভাবেও বেশিদিন চলল না। ১৮৯৬ সালের ৩০ মার্চ আবার ধরা পড়লেন এলিজাবেথ ডায়ার। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে জুরিরা সময় নিয়েছিলেন মাত্র সাড়ে চার মিনিট। সেবছর ১০ জুন ফাঁসি দেওয়া হল এলিজাবেথ ডায়ারকে।
আরও পড়ুন
পরিবেশকর্মীরা ‘দেশের শত্রু’, একের পর এক খুনের সাক্ষী ফিলিপিন্স
এলিজাবেথের বিরুদ্ধে সরাসরি ১৪ জন শিশুকে হত্যার অভিযোগ ছিল। তবে তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান ছিল, সংখ্যাটা কোনোভাবেই ৪০০-র কম নয়। তাঁর মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে শিশু দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু আইনি কড়াকড়ি শুরু হয়। তবে ইতিহাসে আর কোনো এলিজাবেথ ডায়ার জন্মাননি কোনোদিন। আর কোনো হত্যাকারীর হাতে এতো বেশি শিশু প্রাণও হারায়নি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। তবে পুলিশের আর্কাইভে এখনও সেসব নৃশংস হত্যার বিবরণ আছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পর্যন্ত তাঁর কোনো অনুশোচনা ছিল না। ইতিহাসে অনেক নৃশংস পুরুষের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এমন নৃশংস মহিলার উদাহরণ বোধহয় সত্যিই বিরল।