মাস্টারদার পরেই তিনি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ‘সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড’ অম্বিকা চক্রবর্তী

১৯১১ সাল। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স। সমস্ত সদস্যরা জান লড়িয়ে দিচ্ছেন প্রস্তুতির জন্য। পাশেই কর্ণফুলি নদী। ওপার থেকে ১০-১২ জনের একটি দল আসছিল চট্টগ্রামে, কনফারেন্সে যোগ দিতে। হঠাৎই, প্রবল দুর্যোগ! কর্ণফুলি রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠল। এরই মধ্যে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। চট্টগ্রামে যে দলটি আসছিল, তাঁদের নৌকাটি ডুবে যায়। যাত্রীরা কে কোথায়, কেউ জানেন না। এমন সময় ছুটে এল এক বছর কুড়ির তরুণ। কোনো কিছুর পরোয়া না করে, জামাটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওই উত্তাল নদীতে। এ কী করছে ছেলেটা! কিন্তু একাই সব যাত্রীকে উদ্ধার করে ডাঙায় নিয়ে আসেন ওই তরুণ। হাওয়ায় কথা ছড়ায়। সব জায়গায় ছড়িয়ে গেল এই সাহসিকতার কথা। চট্টগ্রামের কনফারেন্সে এই কথা শুনলেন স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে ডেকে নিলেন ওই বছর কুড়ির তরুণ, অম্বিকা চক্রবর্তীকে। নিজের পকেটঘড়ি তুলে দেন অম্বিকা’র হাতে।

আরও পড়ুন
ভাষাভিত্তিক রাজ্য চাই, ৫৮ দিন অনশনের পর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীর

ইতিহাস পরে তাঁকে মনে রেখেছে অন্য অনেক কারণে। চট্টগ্রাম তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ঠিক যেভাবে উত্তাল কর্ণফুলিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সেরকমই কারোর পরোয়া না করে স্বাধীনতা আন্দোলনেও নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। অম্বিকা’র কাছে একটাই চিন্তা, দেশের মুক্তি। স্বাধীন ভারত। ছোটো বয়সেই জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যাতায়াত শুরু। সেজন্য বাড়িতে বকা খাওয়া, মারধোর। কিন্তু কোনো কিছুতেই যে থামানো যাচ্ছে না অম্বিকা’কে! তাঁকে যে থামানো যায়নি কখনও।

আরও পড়ুন
ভাষাভিত্তিক রাজ্য চাই, ৫৮ দিন অনশনের পর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীর

সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। একদিকে সমরাঙ্গনে ব্রিটিশ সেনা, অনদিকে ভারতে তৈরি হচ্ছে বিপ্লবের মহামঞ্চ। এই মঞ্চে যোগ দেন অম্বিকা চক্রবর্তীও। ১৯১৬-এর শেষদিকে প্রথমবার গ্রেফতার হন। ছাড়াও পেয়ে যান দুই বছর পর। ততদিনে তাঁর জীবনে ঘটে গেছে একটি পরিবর্তন। তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন এক নতুন মানুষ। ঠিক নতুন না, পাশের গ্রামেই থাকে ছেলেটা। পড়াশোনায় বেশ ভালো। অঙ্কের শিক্ষক। কিন্তু বিপ্লবের রক্ত ছেলেটার ভেতরে ভেতরে ফুটছে! ওঁর নাম সূর্য সেন…

আরও পড়ুন
বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা গোটা বাংলাদেশ, খুলনার তখনও লড়ছে স্বাধীনতার জন্য

সেই থেকে শুরু সূর্য সেন আর অম্বিকা চক্রবর্তীর একসঙ্গে পথ চলা। ১৯১৮-এর শেষদিকে তাঁরা দুজন চট্টগ্রামে তৈরি করেন একটি গোপন বিপ্লবী দল। সঙ্গে যোগ দেন চারুবিকাশ দত্ত, নগেন্দ্রনাথ সেন, অনুরূপ সেনরা। চট্টগ্রামেই একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ওখানে গোপন আখড়া তৈরি করেন অম্বিকা। সূর্য সেনও সঙ্গে ছিলেন। আস্তে আস্তে সদস্যও বাড়তে থাকে দলের। যোগ দেন গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহরা। তৈরি হতে থাকে ব্রিটিশদের ত্রাস জাগানো একটি সংগঠন।

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার জন্য তুলে নিয়েছিলেন বন্দুক, আজ জুতো সেলাই করে পেট চালান মুক্তিযোদ্ধা

শুধু ব্রিটিশদের নয়, মৃত্যুকেও বারবার ফাঁকি দিয়েছেন অম্বিকা চক্রবর্তী। প্রথমেই চলে আসবে ১৯২৩ সালের নাগরখানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধের কথা। তার আগেই বিপ্লবীরা টাইগার পাস সড়ক মোড়ে দিনের আলোতে ব্রিটিশ রেল কোম্পানির টাকা লুঠ করেন। তাঁর সপ্তাহ দুই পর পুলিশরা হানা দিলেন বিজ্ঞানীদের ডেরায়। বাঁধল যুদ্ধ। আহত হলেন সূর্য সেন আর অম্বিকা চক্রবর্তী। ঠিক করলেন, জীবিত অবস্থায় কিছুতেই ধরা দেবেন না। খেলেন সায়ানাইড। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, দুজনের কেউই মারা গেলেন না। বেঁচে গেলেন বিষের প্রকোপ থেকে। তাঁদের সুস্থ করে বন্দি করা হল। একবার ভাবুন তো, এই দুজন যদি তখনই মারা যেতেন, তাহলে কি পরবর্তী দুঃসাহসিক ঘটনাগুলো কখনও ঘটত?

আরও পড়ুন
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ঝাড়ুদার থেকে ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়’ – রাসবিহারীর ছদ্মবেশে নাস্তানাবুদ পুলিশ

এত কথার মাঝে ১৯৩০ সালের কথা না এলে ইতিহাসের একটা মহান অংশের অবমাননা হবে। জেল থেকে একে একে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহরা ছাড়া পান। এরপর পরিকল্পনা চলতে থাকে আসল উদ্যোগের। চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে হবে। অস্ত্রাগার দখল করতে হবে। ’৩০-এর ১৮ এপ্রিল। ৬৫ জন বিপ্লবীকে নিয়ে শুরু হল অভিযান। দুটো দলে ভাগ হয়ে যায় সবাই। একটির নেতৃত্বে থাকেন সূর্য সেন, অন্যটির দায়িত্বে অম্বিকা চক্রবর্তী। মাস্টারদার পরেই চট্টগ্রামের ওই বিপ্লবী সংগঠনের কার্যত সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে শহরের সমস্ত টেলিগ্রাম ও টেলিফোন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়। একপ্রকার বিচ্ছিন্নই করে রাখা হয় চট্টগ্রামকে। তার পরের অধ্যায়টা আমাদের সকলেরই জানা। স্বাধীনতার আগেই, অন্তত চারদিন চট্টগ্রামের ব্রিটিশ মুক্ত হয়ে যাওয়া…

আরও পড়ুন
খুলনার ফাতেমা জুয়েলার্সের সঙ্গে জড়িয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কীভাবে?

কয়েকদিন পর কিছু বিপ্লবী আশ্রয় গ্রহণ করে কাছের জালালাবাদ পাহাড়ে। অভুক্ত, ক্লান্ত সঙ্গীদের সঙ্গে রয়েছেন অম্বিকাও। এমন সময় ব্রিটিশ পুলিশ ঘিরে ফেলল পাহাড়। শুরু হল গুলির লড়াই। গুরুতর আহত হলেন অম্বিকা চক্রবর্তী। সবাই ভাবেন, মারাই গেছে সে। কিন্তু এবারও মৃত্যুকে ফাঁকি দিলেন তিনি। গভীর রাতে জ্ঞান ফিরে এলে, ওই অবস্থাতেই পালিয়ে যান অন্যত্র। ধরাও পড়েন পরবর্তীতে। প্রথমে ফাঁসির হুকুম দেওয়া হলেও, পরে সেটা বদলে হয়ে যায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে মুক্তি পান তিনি। ততদিনে খবর পেয়ে গেছেন, তাঁর সঙ্গীরা অনেকেই মৃত। শহিদ হয়েছেন সূর্য সেন, প্রীতিলতারা।

আরও পড়ুন
৭২ বছর পরে রূপকথার মিলন স্বাধীনতা সংগ্রামী আর তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর

মনে প্রাণে ছিলেন বামপন্থী। মুক্তি পাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট দলে যোগ দিলেন। পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ডেও গিয়েছিলেন। এই দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশও নিয়েছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে দক্ষিণ টালিগঞ্জ থেকে লড়েছিলেন। জিতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সদস্যও হয়েছিলেন। কিন্তু বারবার যিনি মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে এসেছেন, শেষে এসে আর পার পেলেন না। একটা পথ দুর্ঘটনায় মারা যান চট্টগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী। দিনটি ছিল ৬ মার্চ, ১৯৬২। ৭০ বছর ছুঁয়েছিলেন তিনি।

Powered by Froala Editor