আমাজনকে পোড়াচ্ছি আমরাই

পৃথিবীর ফুসফুস জ্বলছে!

সোশাল মিডিয়ার দৌলতে আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যের পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার খবর ও দৃশ্য আমাদের তছনছ করছে প্রতি মুহূর্তে। তছনছই তো। বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে হাজারের পর হাজার কিলোমিটার অরণ্য। ঝলসে পড়ে থাকা কুমির, শ’য়ে শ’য়ে ঝলসে যাওয়া হরিণ, জাগুয়ার… আগুনে পুড়ে মৃত্যু ঠিক কতটা জ্বালাধরা? ভাবলেই ঘুম ছিটকে যাচ্ছে চোখ থেকে। অস্বস্তি, দম চাপা কষ্ট, তছনছ।

https://www.youtube.com/watch?v=kA7opFdGs7g

আমরা ইতিমধ্যেই ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ থেকে জেনে ফেলেছি শুকনো অথচ ভয়ঙ্কর হিসেবগুলিও। গোটা পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন আসে এই আমাজন থেকেই। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্রের ১০ শতাংশ আছে এই অরণ্যেই। আছেন অসংখ্য মূলনিবাসী মানুষও। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে আর মাত্র ৪-৫ বছরেই বরফশূন্য হয়ে পড়বে দুই মেরু, গলে যাবে দুই তৃতীয়াংশ হিমবাহ। সেইখানে দাঁড়িয়ে আমাজনের এই ভয়াবহ দাবানল আরও কতটা কার্বন উগড়ে দিল? কতখানি অক্সিজেন গিলে নিল? ভাবলেই অস্থির লাগছে। আমরা শুনছি একসঙ্গে ন’হাজারেরও বেশি দাবানল লেগেছে আমাজনে। যা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। আমরা শুনছি, প্রায় আড়াই সপ্তাহ এই দাবানলের খবর বেমালুম চেপে গেছিল মিডিয়া। আগুন নেভানোর কোনও চেষ্টাই হয়নি। আমরা শুনছি, ব্রাজিলের অতি দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো এখনও অন্যদের দোষারোপ এবং নিজের রক্ষণে ব্যস্ত। আমরা শুনছি, আগুন নেভার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন
আমাজনের বিধ্বংসী আগুন নেভাতে বিশ্বের বৃহত্তম জলের ট্যাংকার ওড়াচ্ছে বলিভিয়া

চারপাশে হঠাৎ করেই বোলসোনারোকে দোষারোপ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘ইনপে’ আগেই জানিয়েছিল, আমাজনে নজিরবিহীন ন’হাজার দাবানলের কথা। তা দেখে মিথ্যে তথ্যপ্রদানের অজুহাতে ইনপে-র প্রধান রিকার্দো গালভাওকে ক’দিন আগেই বরখাস্ত করেছিলেন বোলসোনারো। পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, মূলনিবাসী মানুষদের একটা বড় অংশ বলছেন, এই আগুন মানুষেরই লাগানো। বন পুড়িয়ে ফেলে আমাজনের তলায় থাকা বিপুল খনিজ সম্পদ লুট করাই আসল উদ্দেশ্য। আর, এই নিয়ে কোনও লুকোছাপাই তো ছিল না নতুন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো-র। তাঁর ঘোষিত নীতিই ছিল, আমাজন কেটে খনিজসম্পদ উত্তোলন। তাঁর জমানায়, বিগত ১১ মাসে হেক্টরের পর হেক্টর আমাজনের অরণ্য উধাও হয়ে গেছে। এবারে এই আগুন। কর্পোরেটের লোভ আর একজন প্রেসিডেন্টের এমন মনোভাব কীভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিতে পারে! এ’কথাই বলছেন সবাই।

https://www.youtube.com/watch?v=NAQZvlaNF4s

না, সবাই নয়। বলছেন অনেকে। এখনও ইউরোপের বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা চুপ, এখনও এ-দেশের বড় মিডিয়ার প্রথম পাতায় কাশ্মীর, চিদম্বরমের গ্রেপ্তারি। এখনও উন্নয়নের স্বপ্নগর্ভ প্রতিশ্রুতিতে আমাদের অনেকেরই বুঁদ হওয়া। এখনও, এখনও, এখনও…

বোলসোনারোকে নির্বাচিত করে এনেছিলেন ব্রাজিলের মানুষরাই। ট্রাম্পকেও নির্বাচিত করেছেন মার্কিনি জনতা। যে ট্রাম্প পরিবেশের ওপর থেকে রক্ষাকবচ সরিয়ে নিতে খুবই উদ্যোগী। কারণ টাকা প্রয়োজন, মুনাফা। এঁরা কেউই ক্ষমতায় আসার পর এঁদের লুকোনো তাস বের করেননি। এঁদের ঘোষিত নীতিই ছিল প্রকৃতিকে লুট করে শিল্প, খনিজ তুলে এনে মুনাফা। মানুষ সেই নীতিতে সায় দিয়েছেন, দিচ্ছেন। কারণ, এইসব উন্নয়ন আসলে মানুষেরই স্বার্থে। মানুষ উন্নয়ন চান, তাতে পরিবেশ ধ্বংস হলে হবে। এটা ব্রাজিল, আমেরিকার ব্যাপার নয়। মানুষ চুপ বলেই ভারতে, ইন্দোনেশিয়ায়, তৃতীয় বিশ্বে তছনছ হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। কাটা পড়ছে বন। জীববৈচিত্র ধংস হচ্ছে। এই পৃথিবী যে শুধু মানুষের নয়, তা ভাবার জায়গায় ক’জন আছে বলুন তো? আমাদের এখন ভয়, পৃথিবী যদি মনুষ্য-বসবাসেরও উপযোগী না থাকে! সেই ভয়টাও আলগা আলগা। তাই এখনও যশোর রোডে গাছ কাটার নিদান হাঁকা হয়। আমরা অধিকাংশ মানুষ চুপ করে বসে থাকি। এখনও অযোধ্যায় বন কেটে পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পের কথা বলা হয়, সমাজ সেটা শুনেও নড়ে না। এখনও রাজস্থান থেকে, মণিপুর থেকে পাহাড় উধাও হয়ে যায়, বন উধাও হয়ে যায়। আমরা খবর শুনে মুখে চুক চুক শব্দ করি। তারপর, সাধ্যমতো প্রকৃতি ধ্বংস করি। আরও আরও ভোগ। ভোগের স্বপ্ন। এক ভোগজর্জর আধুনিক সমাজ…

আরও পড়ুন
৩-৪ বছরেই বরফশূন্য হবে দুই মেরু, পৃথিবীকে বাঁচাতে হাতে সময় আর মাত্র ৫ বছর!

সমাজ রুখে দাঁড়ালে কোনও আগুনই এতদিন জ্বলতে পারে না, কোনও বনই হারিয়ে যেতে পারে না, কোনও জীবপ্রজাতিই লুপ্ত হতে পারে না কর্পোরেটের লোভের কবলে পড়ে। সমাজ নাকচ করলে কর্পোরেট মাল বেচবে কাকে? আর সমাজ মান্যতা দিলে এইসবই সত্য, এইসবই নিয়ম। আমাজনে আগুন লাগবে, দাবানল বাড়তেই থাকবে ইন্দোনেশিয়ায় এমনকি ভারতের উত্তরাখণ্ডেও…

আমাজনকে বোলসোনারো পোড়াননি। আমরা সবাই মিলে পোড়াচ্ছি। আমাদের ভোগের লোভ পোড়াচ্ছে। মানুষ পোড়াচ্ছে।

আমাদের তছনছ হয়ে যাওয়া বোধগুলোতেও যদি এমন রাক্ষুসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া যেত।