জার্মানির সালজবার্গ শহর থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্ব। সেখানে হিমশীতল পার্বত্য উপত্যকায় লুকিয়ে রয়েছে এক রহস্যময় গুহা। কিন্তু কী আছে এই গহ্বরের মধ্যে? উনিশ শতকের শেষ অবধি স্থানীয়দের বিশ্বাস ছিল, আদতে এই গুহায় বসবাস করে স্বয়ং শতয়ান। তার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ই গুহামুখে থেকে উৎপন্ন হয় তুষারের ঝড়। ১৯০০ সালে প্রথম এই গুহায় অভিযান চালান সালজবার্গের স্পিলিওলজিস্ট আলেকজান্ডার ফন মার্ক। তারপর গোটা বিশ্বের কাছে খুলে যায় এক আশ্চর্য দুনিয়া। প্রায় ২৬ মাইল দীর্ঘ এই গুহা আক্ষরিক অর্থেই যেন স্বর্গরাজ্য। জায়গায় জায়গায় সেখানে জমে রয়েছে নীল তুষারের চাদর, কোথাও আবার বরফে পরিণত হচ্ছে আস্ত ঝর্না।
না, শুধু সালজবার্গের এই গুহাই নয়, গোটা আল্পস-জুড়েই (Alps) ছড়িয়ে রয়েছে এ-হেন একাধিক গুহা। মুখচলতি ভাষায় যারা পরিচিত ‘আইস কেভ’ (Ice Cave) নামে। প্রতিবছর মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে অন্ততপক্ষে ২ লক্ষাধিক পর্যটক ভিড় জমান প্রকৃতির এই আশ্চর্য রূপ দেখতে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, আর কয়েক দশকের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে এই অবাক-পৃথিবী।
সালজবার্গের এইসকল গুহায় সারাবছর বরফ জমে থাকলেও, তাদের চেহারা একরকম থাকে না। শীতকাল পড়লেই ক্রমশ বাড়তে থাকে তুষারের আস্তরণ। প্রাকৃতিক জলধারাগুলি জমাট বাঁধে বরফে। আবার গ্রীষ্মে ক্রমশ সেই বরফ গলে তৈরি হয়ে যায় যাতায়াতের রাস্তা। গুহার পাথুরে ছাদে বরফের আস্তরণের গভীরতা কমে আসে মাত্র ১৬-১৭ ফুটে। তবে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে গ্রীষ্মে যেমন দ্রুত বরফ গলছে, তেমনই শীতের মন্থর হচ্ছে তুষারফলের হারও। যার ফলে ক্রমশ পাতলা হচ্ছে আল্পসের এইসকল বরফ-গুহার চাদর।
গবেষকদের কথায়, এইসকল গুহাগুলি আসলে আল্পসের ‘ভূগর্ভস্থ হিমবাহ’। একদিকে সেগুলি যেমন ইউরোপের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনই বহু ইউরোপীয় নদীর জলপ্রবাহও নির্ভরশীল এই গুহাগুলির ওপর। ফলে, সার্বিকভাবে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে আইস কেভের গলন। ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯০০ সালের পর থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর কয়েক দশকের মধ্যেই তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলেই অনুমান গবেষকদের। এমনকি চলতি শতকের শেষে তাপমাত্রার বৃদ্ধি পৌঁছাতে পারে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও। অন্যদিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাত্রা অতিক্রম করলেই অস্তিত্ব হারাতে পারে ইউরোপের এই বরফের সাম্রাজ্য। সাদা কার্পেট ও ত্রিপলে মুড়ে এইসকল হিমবাহের গলন আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি-সহ একাধিক দেশ। তবে কার্বন নির্গমন শূন্যে না এলে, প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় আটাকনো এক-কথায় অসম্ভব…
Powered by Froala Editor