বাংলার বুকে নিজস্ব লিপিনির্মাণ ও ধানীরাম টোটোর ভাষা-সংরক্ষণের কাহিনি

“ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে
ধুলোবালু চরে, পাখিদের নীড়ে
তুমি আমি গাই গানের বর্ণমালা…”

রেডিও-তে এই গান বেজে উঠলেই আনমনা হয়ে যেতেন আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা ধানীরাম টোটো (Dhaniram Toto)। গানের শুরু বা কথা নয়, বরং তাঁকে তাড়া করে বেড়াত ‘বর্ণমালা’ (Alphabet) শব্দটি। কারণ, বর্ণমালা বলতে ছোটো থেকে তিনি যা চিনেছেন তা হল বাংলা, ইংরাজি কিংবা নেপালি হরফ। অথচ, তাঁর নিজের মাতৃভাষার কোনো হরফ নেই, নেই বর্ণমালা। 

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। বাংলা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক ভাষা-উপভাষা। তাদের শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বাংলার থেকে। অথচ কোনো লিপি না থাকায় বাংলার হরফেই লেখা হয় এইসকল ভাষা। আজ থেকে কয়েকবছর আগে পর্যন্তও সেই তালিকাতে ছিল টোটো ভাষা (Toto Language)। আজ থেকে বছর ছয়েক আগে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র লিপি পায় এই উপজাতি ভাষাটি। যার নেপথ্যে রয়েছেন ৫৯ বছর বয়সি ধানীরাম। 

দশন শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও, তিনি ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন দুটি উপন্যাস, ‘ধানুয়া টোটোর কথামালা’ এবং ‘ডুমরা থিরতে’। হ্যাঁ, এই দুই উপন্যাস লেখার সময় তাঁকে ব্যবহার করতে হয়েছিল বাংলা হরফই। তবে আখ্যান রচনার সময়ই, নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালা তৈরির চিন্তাভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করে তাঁর মনে। 

সেটা ছিল ২০০৫ সাল। টোটো ভাষার স্ক্রিপ্ট ও হরফ তৈরির অভিযান শুরু করেন ধানীরাম। পরবর্তী ১০ বছর ধরে চলেছে প্রচেষ্টা। ২০১৫ সালে তাঁর হাত ধরেই প্রকাশ পায় টোটো ভাষার সম্পূর্ণ বর্ণমালা। ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৯টি স্বরবর্ণ এবং ৬টি ডিফথং নিয়ে তৈরি এই বর্ণমালা। তাছাড়া টোটো ভাষার শব্দ, শব্দের অর্থ এবং ধ্বনির বিবর্তন নিয়ে একটি শব্দভাণ্ডারের সম্পাদনাও করেছেন ধানিরাম। 

অবশ্য এই লড়াই তাঁর একার নয়। এই বর্ণমালা তৈরিতে সামার ইনস্টিটিউট অফ লিঙ্গুয়েস্টের অস্ট্রেলিয়ান ভাষাবিদ টোবি অ্যান্ডারসনের অবদানও কম নয়। প্রশিক্ষিত ভাষাবিদ না হওয়ায়, ধ্বনির সঙ্গে শব্দ মেলাতে এবং সেই অনুযায়ী লিপি তৈরিতে প্রাথমিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন ধানীরাম। পর্যটক হিসাবেই টোটোপাড়ায় হাজির হয়েছিলেন টোবি। সেইসময়ই তাঁর সঙ্গে আলাপ ধানীরামের। পরবর্তী টোবির কাজই অনুপ্রেরণা জোগায় তাঁকে। যৌথভাবে শুরু হয় লিপি তৈরির কর্মকাণ্ড। ২০১৫ সালের ২২ মে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় এই বর্ণমালা। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্থাৎ, আইএসও কোড-ও পেয়েছে টোটো লিপি। 

ভারত-ভুটান সীমান্তের কাছে আলিপুরদুয়ার জেলার শুভপাড়া, ধুনচিপাড়া ও পঞ্চায়েত পাড়ায় বাস টোটো উপজাতির। অবশ্য তাঁদের কথ্যভাষা ‘টোটো’ নামা পরিচিত হলেও, ভাষাবিদ টোবির মতে এই ভাষা আসলে সিনো-তিবেতিয়ান বা ইন্দো-বর্মান ভাষা পরিবারের অংশ। সেই সূত্র ধরেই তিনি এই ভাষার নামকরণ করেন ‘ডেংকা’। 

বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতের মধ্যে বিপন্নপ্রায় ভাষার তালিকায় অন্যতম টোটো ভাষা। ২০০৯ সালে এই ভাষাকে বিলুপ্তপ্রায়ের তকমা দেয় ইউনেস্কোও। বর্তমানে এই ভাষার বক্তার সংখ্যা মাত্রা ১৪১১ জন। তবে ধানীরামের উদ্যোগ এবং টোটো ভাষার বর্ণমালার সৌজন্যেই ক্রমশ নতুন করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ফিরছে এই উপজাতি-ভাষা। একইভাবে লড়াই করছেন ধানীরামের মতো এই ভাষার বহু কথাশিল্পীও…

Powered by Froala Editor

More From Author See More