একে একে নিভিছে দেউটি। চলে গেলেন বাংলা কবিতার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অবশ্য শুধু কবিতাই বা বলা কেন, কবিতা থেকে শুরু করে গদ্য সাহিত্য, প্রবন্ধ অথবা অনুবাদ সাহিত্যের যে কোনও শাখাতেই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন রংবেরঙের কুঁড়ি। প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ছিলেন অলোকরঞ্জন। সাহিত্যে যে শুধু নাক উচুঁ এলিট সম্প্রদায়েরই একচ্ছত্র অধিকার, এমন মনোভাব ছিল না কখনোই। যদিও মননে তিনি ছিলেন প্রবলভাবে আন্তর্জাতিক। মূল জার্মান সাহিত্যের কাজগুলিকে বাংলা ভাষায় যেমন অনুবাদ করেছেন, তেমনি বহু বাংলা ও সাঁওতালি কবিতা-নাটক অনুবাদ করেছেন পাশাপাশি ইংরেজি ও জার্মান ভাষায়।
এই অনলাইনের জগতে নিজেকে বলতে ভালোবাসতেন ‘অফলাইনার’ হিসেবে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়াময় ক্যাকোফোনির বাইরে নিজেকে রেখে দিতে ভালবাসতেন। জীবনের একটি বড় অংশ কর্মসূত্রে বিদেশে কাটালেও বিশেষভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন বাংলার কথা উঠলে। এবং বাংলা অর্থে, কাঁটাতার বিহীন বাংলা। বলেছিলেন, কলকাতা এবং ঢাকার মধ্যে যে কোনও পার্থক্য নেই সেটা প্রতিদিনই নতুন করে উপলব্ধি করছেন তিনি।
বাঙালি কবিদের মধ্যে অলোকরঞ্জনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল জীবনানন্দ দাশের কবিতা। জীবনানন্দের কবিতার বিন্যাস এবং আয়তনের গভীর বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি। প্রিয় কবির কবিতায় যেমন বারবার ফিরে এসেছে হেমন্ত, সেই হেমন্তেরই একটা দিনে মহাকালের পথে পাড়ি দিলেন অলোকরঞ্জন। আমরা ভাবতে বসি, হঠাৎ করে কি আর দু’মুঠো ভাত অথবা দুটো রুটি বেশি চেয়ে নেবেন কবি এর পরেই? যেমন লিখেছিলেন:
খুব সম্ভব মৃত্যুর মুখ থেকে
ফিরে এসে তাঁর খিদে পেয়েছিল খুব,
বললেন : ‘এসো, সেরে নিই প্রাতরাশ’
(তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
হেমন্তের ঝরাপাতাই তো! অজস্র ছাত্র-ছাত্রী এবং মুগ্ধ পাঠকের মধ্যে দাঁড়িয়েও বরাবর নিজেকে অপূর্ণ মনে করেছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বরাবরই মনে করেছেন, যা কিছু তিনি পেয়েছেন তা অনেক; বরং কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া হল না তাঁর। সেই আকুতি যেন ধরা পড়েছে অলকরঞ্জনের লেখায় প্রথম থেকেই। 'যৌবন বাউল' গ্রন্থে লিখেছেন,
গেল আমার ছবি-আঁকার সাজসরঞ্জাম
কোথায় পটভূমি কোথায় পড়ে রইল তুলি,
তুমি আঁকলে ছবি আবার তুমি আঁকলে নাম,
ফকিরি সাজ নেওয়ার ছলে ভরে নিলাম ঝুলি,
শুধু নিলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।
আকাশ আমার ক্ষমা, আমার অসীম নীহারিকা;
প্রিয়া, আমার ক্ষমা, আমার নিরালা অঙ্গনা;
মাগো, আমার ক্ষমা, আমার প্রদীপ অনিমিখা;
মর্ত্যভূমি ভরা আমার আনন্দবেদনা;
নিয়ে গেলাম সব মাধুরী, দিতে পারলাম না।
যদিও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অলোকরঞ্জন সরাসরি জানিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রিয়তম কবি রায়নার মারিয়া রিলকে। প্রখ্যাত এই কবির সঙ্গে রীতিমতো ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। রিলকের বহু লেখার সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচিত করেছিলেন তিনি। বাঙালি হয়েও মনেপ্রাণে প্রচণ্ড রকম আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক অলোকরঞ্জনকে ভাবিয়ে তুলেছিল বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যা। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন নান্দনিকতা জায়গা থেকে কবিদের সরে এসে ঈশ্বরের পুনর্বাসন ঘটাতে হবে সারা পৃথিবীব্যাপী শরণার্থী ছাউনিগুলোর মধ্যে। তুলনা করে দেখিয়েছিলেন, যেকোনো মহাকবি এই মহৎ রাস্তাই দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন একদিকে লিখছেন 'তাই তোমার আনন্দ আমার পর', তেমনই রিলকে লিখছেন, 'আমি না থাকলে, তুমি বাস্তুহীন, ঈশ্বর তোমাকে / উষ্ণ ও মধুরতম অভ্যর্থনা জানাবে না কেউ'।
আরও পড়ুন
পাতাঝরা হেমন্ত দিনে বিদায় নিলেন 'যৌবন বাউল' অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
অলোকরঞ্জন নিজেও লিখছেন, 'এভাবে নিয়তিকে নির্ধারিত করে দিলে ভালো হয়। যেখানেই নিঃসঙ্গতা, তাকে গড়েপিটে নিয়ে মানুষের উপযোগী করে তোলা, নিজেদের প্রাণ থেকে নিখিলের তহবিলে আয়ুকর দিয়ে যেতে থাকা। নিসর্গকে দীর্ঘ করার জন্য অশ্বত্থের রক্তার্জিত আয়কর দিতে হয়।' (আয়ুকর : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
অসম্ভব এক সহজ অথচ জটিল, মায়াময় অথচ নির্বিকার লেখনীতে একের পরে এক ম্যাজিক উপহার দিয়ে গিয়েছেন অলোকরঞ্জন। অজস্র কবিতা, যার মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ বেছে নেওয়া হয়ত একপ্রকার অসম্ভব। তিনি 'শিল্পের সাহসে' উইপিং উইলোর নাম কখনো বদলে দিতে পারেন 'বিষাদবৃক্ষ', কিংবা কখনো রাখতে পারেন 'আনন্দলহরী'। আদিবাসী কন্যার রূপে মুগ্ধ হওয়ার পরেও নিজেকে সম্বরন করার বশে লিখতে পারেন, 'বেজেছে এক ধ্বনির মণিহার-- / এ মণিহার আমায় নাহি সাজে।'
মেঘ ভাঙা চাঁদের আলোর মতো অলোকরঞ্জনের কবিতা ভরিয়ে রাখবে আমাদের। প্রথম বই 'যৌবন বাউল' প্রকাশ পেতে পারত 'পরান আমার স্রোতের দীয়া' নামেও। যদিও সতীর্থ শঙ্খ ঘোষ তার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন পঞ্চাশের দিনগুলিতে বাংলা কবিতার যুবরাজ ছিলেন অলোকরঞ্জন। তবু সব যুবরাজকেই তো ছেড়ে দিতে হয় সিংহাসন। পাড়ি দিতে হয় অন্য মেধার গ্রহে। পাড়ি দিতে দিতে কবি রেখে যান অমোঘ কিছু স্তোত্র:
আরও পড়ুন
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯৩৮-২০২০)–এর স্বপ্ন ও গন্তব্য
কে যেন আমার বৃষ্টিমথিত শার্সির কাচে
বলল : 'তোমার ঠিকানা লিখে দাও'—
ভিজে গেল শুধু একটার পর অন্য খাগের
কলম, আখর ফুটলে না একটাও।
তখন সে এক শ্লেটের উপর মোম মেখে দিয়ে
বলল : 'ঠিকানা লিখে দাও এক্ষুনি’—
সমস্ত খড়ি খোয়ালো তাদের মেধাবী ক্ষরণ,
বুকের ভিতরে প্রহত মাদল শুনি।
সে তখন টেনে হিঁচড়ে আমায় নিয়ে গেল এক
পাঁচিলের কাছে—- শ্যাওলায় ছন্ন তা—
হাতে তুলে নিয়ে নির্জিত খুর আমাকে বলল
'এইবারের বাপু চলবে না অন্যথা…'
ছিপছিপে তার শরীর, চিবুকে মমতার টান,
তথাপি কেমন হিংস্র দেখাল তাকে,
কোমরে ঘুনসি বেঁধে সে আমায় টেনে নিয়ে গেল
বধ্যভূমিতে, তবু তাকে ভালো লাগে।
ট্রামের লাইনে মাথা গুঁজে ঠিক সেই কথাটাই
তার দিকে মুখ তুলে
বলতে গেলাম, ঘলঘসা ফুলে ছড়ে গেছে ঠোঁট,
এবং আমার ঠিকানাও গেছি ভুলে!
(ঘলঘসা ফুলে ছড়ে গেল ঠোঁট : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
ছবি ঋণ- অর্ক দেব
আরও পড়ুন
প্রয়াত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য হারাল আরও এক নক্ষত্রকে
Powered by Froala Editor