এতটা কড়া করে বোধহয় না-বললেও চলত। বিশেষত আজ— রাসপূর্ণিমায়, যা আসলেই ফুল খেলবার দিন। এবং ঠিক সেই কারণেই, এ-লেখা প্রকাশের জন্য এই দিনটিকেই বেছে নেওয়া হল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা-পঙক্তিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করাও সুচিন্তিত। একটা জনপদের ঐতিহ্যকে চোখের সামনে হারাতে দেখা ও কিছু করতে না-পারার অসহায়তা মিশে থাকবে এ-লেখার সর্বাঙ্গে। যদিও আলোচিত জনপদ— চন্দ্রকোণা একটি উদাহরণমাত্র। বাংলার সর্বত্রই কমবেশি চোখে পড়ে এমন ধ্বংসের নজির। কখনো মানুষের সচেতন উদ্যোগে, কখনো-বা অবহেলায় ও সময়ের আঘাতে হারায় সবকিছু। আমরা যারা ইতিহাস ভালোবাসি, দূর থেকে অশ্রুবর্ষণ ছাড়া বিশেষ কিছুই করতে পারি কি?
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় এ আমার প্রথম যাওয়া নয়। পাঁচ বছর আগেই গিয়েছিলাম, অবশ্য তা ছিল নিছক ভ্রমণ। এবার রীতিমতো ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়েই যাওয়া। যদিও চন্দ্রকোণার ইতিহাস তুলে ধরা এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়, সে-দায়িত্ব স্থানীয় ইতিহাসবিদদের। আমি শুধু কিছু উদাহরণ তুলে ধরতে পারি বাইরের পাঠকদের কাছে।
চন্দ্রকোণাকে আমি ‘মন্দিরনগরী’ বলতে ভালোবাসি। বাংলার আর-কোনো শহরে এত প্রাচীন মন্দির টিকে আছে কিনা আজও, জানা নেই। এ-শহরের অলিতে-গলিতে মন্দির। চারচালা, আটচালা, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন, দেউল, চাঁদনি— কী নেই! গত পাঁচশো বছরের মধ্যেই তৈরি হয়েছে সেসব। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে বাংলার সঙ্গে উড়িষ্যার সূক্ষ্ম মিশ্রণ। রয়েছে একাধিক মাজার ও অস্থল। গাছতলায় অসংখ্য লৌকিক দেব-দেবীর অধিষ্ঠান। চন্দ্রকোণার এই সমৃদ্ধির পিছনে লুকিয়ে এর দীর্ঘ ইতিহাস— বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব, একের পর এক রাজবংশের রাজত্ব, দাক্ষিণ্য ও মনোনিবেশ। বিগত শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্তও অক্ষুণ্ন ছিল এর রমরমা। পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথার বিলোপের পর থেকেই ক্রমাবনতি হয় পরিস্থিতির। আর আজ, অতীতের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই নহে এ-নগরী।
প্রথমেই আসি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গাছশীতলা মোড়ের কথায়। বছর পাঁচেক আগেও দেখেছি এই মোড়ে অবস্থিত শিবমন্দির। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। মন্দিরের দেওয়ালে অপেক্ষারত রমণীর কারুশিল্প। তিন বছর আগে খবর পাই, রাস্তা সম্প্রসারণ ও ‘উন্নয়ন’-এর স্বার্থে ভাঙা পড়েছে সে-মন্দির। পুরনো বাড়িঘর ভাঙার উদাহরণ থাকলেও, সচরাচর মন্দির ভাঙার পদক্ষেপ নেয় না কেউ। চন্দ্রকোণায় সাধিত হল সে-কীর্তিও। হারিয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহ্য।
শুনেছি স্থানীয় কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলেন, তাতে রাজনৈতিক ইন্ধনও ছিল, তবে তা সবই ‘মন্দির’-বিষয়ক। ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারোর। সে-মন্দির ভাঙা পড়ল, অদূরে এক ফাঁকা জায়গায় গড়ে তোলা হল নতুন মন্দির। নতুন স্থাপত্যটি যে কী কুৎসিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেইসঙ্গে স্থূল অলংকরণ দেওয়ালে। প্রাচীন শিল্পীদের সূক্ষতা, পরিমিতি ও সৌন্দর্যবোধের ছিটেফোঁটাও নেই নবনির্মিত স্থাপত্যে। গাছশীতলা মোড়ের রাস্তা সম্প্রসারিত হয়েছে আজ। ঢালা হয়েছে পিচও। তারপরও ইতিহাসের নির্মম ঠাট্টা— ঠিক কোন জায়গায় মন্দিরটি ছিল, আজও চিহ্নিত করা যায় সে-অবস্থান।
নবনির্মিত স্থাপত্যের বৈকল্য দেখে বিরক্তি জাগা স্বাভাবিক। তবে তার চেয়েও বিরক্তি জাগে প্রাচীন স্থাপত্যের সংস্কার দেখলে। কখনো সারাইয়ের নামে প্রায় পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলা, কখনো আবার পুরনো সব অলংকরণ মিটিয়ে দেওয়া। সেইসঙ্গে চকচকে রঙের প্রলেপ। হেলদোল নেই সাধারণ মানুষের। মন্দিরের নবরূপায়ণ দেখেই তারা খুশি। ঠিক এমনটাই ঘটেছে ঐতিহ্যবাহী পঞ্চরত্ন-রীতির মল্লেশ্বর মন্দিরে। কয়েক শতাব্দী পুরনো এই মন্দিরে রঙের প্রলেপ পড়েছে সম্প্রতি। আর সেই সূত্রেই খোয়া গেছে প্রাচীনত্বের সব ছাপ। মুড়ি-মিছরি একাকার। সংস্কার অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তা হওয়া উচিত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে। যা-হোক করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করতে গেলে, ইতিহাসের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মাসখানেক আগে সংস্কৃত কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির তোরণ।
চন্দ্রকোণার আরও বেশ-কিছু মন্দিরের কপালে জুটেছে এমন অনভিপ্রেত সংস্কার। আর, অসংখ্য মন্দির সেই পদক্ষেপের অভাবে ধ্বংসপ্রায়ও বটে। তাহলে কি একেবারে নষ্ট হতে দেওয়ার চেয়ে কোনোমতে সংস্কার করাই সঠিক পদক্ষেপ? এইখানেই এসে পড়ে উদ্যোক্তাদের সচেতনতার প্রসঙ্গ। তাঁরা যদি বহিরঙ্গে তরতাজা-ভাব ফোটানোর পাশাপাশি ইতিহাসকেও সমান সম্মান দিতেন, বিকল্প পথ বেরিয়ে আসত ঠিকই। কিঞ্চিৎ খরচসাপেক্ষ হলেও সঠিক পদ্ধতিতে স্থাপত্যগুলি সংরক্ষিত করলে আয়ুও বাড়ে, ইতিহাসও অক্ষুণ্ণ থাকে। বৃহত্তর জনসমাজের ইতিহাসবোধের অভাবই তা হতে দেয় না, বলাই বাহুল্য।
ধ্বংসপ্রায় মন্দিরের কথা যখন উঠলই, রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়িকে এড়াব কীভাবে! খুব সম্ভবত সপ্তদশ শতকে নির্মিত এই গড়। পাঁচিলঘেরা ক্ষেত্রে একের পর এক মন্দিরসারি। মূল দেবতা রঘুনাথজীউ, যাঁর সুউচ্চ দেউল রয়েছে। চারপাশে অন্যান্য দেব-দেবীর মন্দির— রাধাকৃষ্ণ, শিব প্রমুখ। একই ক্ষেত্রে এত কারুকার্যময় মন্দিরের সমাহার বাংলায় দুর্লভ। চন্দ্রকোণার মূল আকর্ষণ হতে পারত এই রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি। আজও রঘুনাথজীউ-এর জন্য জায়গাটি অযোধ্যা নামে পরিচিত। কিন্তু সেসব শুধু নামেই। বহুদিন ধরেই পরিত্যক্ত এই গড়। অথচ বছর পঞ্চাশ আগেও সরগরম থাকত এই মন্দির-চত্বর। আজ প্রতিটি মন্দির বিগ্রহশূন্য। ভেঙে পড়েছে বাইরের পাঁচিল, নাটমন্দিরের ছাদ উধাও। চারদিক জঙ্গলাকীর্ণ, আগাছায় ভর্তি। বিপজ্জনক সাপের বসবাস। মন্দিরগুলির ভেতরে গ্রামবাসীরা স্তূপ করে রেখেছে খড়-বিচালি। যত্রতত্র বাঁধা গরু-ছাগল, দেওয়ালে ঘুঁটে। আর রঘুনাথজীউ-এর সুবিখ্যাত দেউল, যা চন্দ্রকোণার গর্ব ছিল একসময়, সম্মুখভাগে ভেঙে পড়েছে প্রায়। মাকড়া পাথরের কঙ্কাল বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে, অনেক পাথর ধসে পড়ে বুজিয়ে দিয়েছে দেউলের একাংশ। তবে ভাগ্যের বিষয়, দেউলটির পশ্চাদভাগ এখনো অক্ষুণ্ণ, ফলে সে-দিকে উঁকি দিয়ে আন্দাজ পাওয়া যায় প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তির। তবে এর আয়ুও বেশিদিন নয়। সামান্য ঝড়-বৃষ্টি-ভূমিকম্পেই যে-কোনোদিন ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে এই দেউল। অবিলম্বে রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ি সংরক্ষণ করা উচিত, প্রশাসন ও স্থানীয় অধিবাসীর যৌথ উদ্যোগে। নইলে চন্দ্রকোণা তথা বাংলার এক অবিস্মরণীয় দলিল-ইতিহাস হারিয়ে ফেলব আমরা।
একই কথা বলা যায় চন্দ্রকোণার একটি ‘অখ্যাত’ মন্দিরের ক্ষেত্রেও। পথে যেতে-যেতে, হঠাৎই চোখে পড়েছিল আড়ালে-থাকা এই মন্দির। বর্তমানে পরিত্যক্ত, অর্ধেক ভগ্ন। সিঁড়ির কাছে খসে পড়েছে দালানের ছাদ। তারপরও, চারচালা এই মন্দিরের অলংকরণ আমাদের বাধ্য করে থমকে দাঁড়াতে। এককালে মন্দিরের গায়ে বসানো ছিল অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক। যতদূর নাগাল যায়, সবই উপড়ে ফেলেছে লোকজন। এ অবশ্য চন্দ্রকোণার প্রায় সব পরিত্যক্ত মন্দিরেরই ভাগ্য। সে যাইহোক, আমাদের আলোচ্য মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের চারপাশের পঙ্খের কাজ দেখে বিস্মিত হতে হয়। এত সূক্ষ্ম কারুকাজ এতদঞ্চলের আর-কোনো মন্দিরে চোখে পড়েনি। গর্ভগৃহের সিংহাসনটি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমন অপূর্ব শিল্পকলা শুধু চন্দ্রকোণা কেন, সারা বাংলাতেই দুর্লভ। তবে, বিগ্রহ নেই কোনো। আশেপাশের দু-চার বাড়ির লোকজন দু-বেলা ফুল-জল দিয়ে যান, না-জানি কোন দেবতার উদ্দেশ্যে।
এ-মন্দির যেহেতু সম্পূর্ণই অনালোচিত, এ-নিবন্ধে লোকশ্রুতি লিপিবদ্ধ করে রাখা যাক। প্রতিবেশী এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই মন্দিরটিতে পূর্বে শীতলা অধিষ্ঠিত ছিলেন, অর্থাৎ ‘শীতলা মন্দির’ হিসেবেই এঁর স্থানীয় পরিচিতি। ঘটেই পূজিত হতেন শীতলা। সিকি শতাব্দী আগে, মল্লেশ্বর মন্দিরের পাশে নতুন মন্দির গড়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় শীতলাকে, মূর্তি এনে মনসা ও ওলাইচণ্ডী-সহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকে এ-মন্দির একেবারে পরিত্যক্ত। এমন ভগ্নপ্রায় দশা হল কীভাবে? বৃদ্ধা জানান, এককালে গুজব রটে, এই মন্দিরের ঈশানকোণ নাকি সোনার ইট দিয়ে তৈরি। ফলে দুষ্কৃতিরা এসে সোনার খোঁজে ঈশানকোণের মন্দিরের দেওয়াল ও ছাদ ভাঙে। বলাই বাহুল্য, কিছুই জোটেনি। তবে, সেই থেকেই এমন অবস্থা মন্দিরটির। এও তবে বয়সজনিত নয়, মনুষ্যকৃত ভাঙন।
তবে, এ-মন্দির যে শীতলার, তা বিশ্বাস করতে পারিনি। স্থাপত্য ও অন্যান্য চিহ্ন দেখে আমার অনুমান, অন্তত শ-তিনেক বছরের পুরনো এটি। আর, শীতলার মতো লৌকিক দেবীর মন্দির এত কারুকার্যময় হওয়া অস্বাভাবিক। গর্ভগৃহের সিংহাসন দেখে আমার ধারণা, অতীতে রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণ এককভাবেই স্থাপিত ছিলেন এখানে। সেই বিগ্রহের অন্তর্ধানের পরে, মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয় প্রাথমিকভাবে। তারপর স্থানীয়রাই শীতলার আরাধনা শুরু করেন। আশেপাশের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মন্দিরটি সংস্কারের পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। শুনে আঁতকে উঠেছি। তাঁদের করজোড়ে অনুরোধ করেছি, এই সুমহান পদক্ষেপটি যেন তাঁরা না নেন। কেন-না, সংস্কার করলে মন্দিরের অপূর্ব সব কারুকাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এঁরা কেউই ইতিহাসের সৌন্দর্য নিয়ে আগ্রহী নন। ফলে, আদ্যোপান্ত নতুন মন্দিরে পরিণত হবে সেটি। তার চেয়ে যদ্দিন আছে, অতীতগরিমা নিয়েই বেঁচে থাক।
এমন গরিমাপূর্ণ অথচ পরিত্যক্ত মন্দিরের সংখ্যা চন্দ্রকোণায় নেহাত কম নয়। ঠিক যেমন বর্তমান মন্দিরটিও। সম্মুখভাগের অলংকরণ মনকাড়া, যদিও নাগালে-থাকা পোড়ামাটির সব অলংকরণ উধাও। প্রস্তরফলক থেকে জানতে পারি, ‘১৭৬৬ শক ১২৫১ সন’ অর্থাৎ ১৮৪৪ সালে নির্মিত হয়েছিল চাঁদনি-রীতির এ-মন্দির। কোন দেবতা ছিলেন, জানার উপায় নেই। মন্দিরের এক-তৃতীয়াংশে থাবা বসিয়েছে পার্শ্ববর্তী জমির পাঁচিল।
অন্যদিকে, চন্দ্রকোণার বিখ্যাত জোড়বাংলা মন্দিরের অবস্থাও তথৈবচ। বয়স আনুমানিক চারশো বছর। লোকশ্রুতি, এককালে বুদ্ধমূর্তি সংরক্ষিত ছিল এখানে। পরবর্তীকালে পূজিত হত বিষ্ণুশিলা। এখন অবশ্য গর্ভগৃহ ফাঁকা। মন্দিরের গ্রিলে বাঁধা ছাগল। দালানে তাদের বিষ্ঠা ছড়িয়ে। মন্দিরের গায়ে দড়ি বেঁধে গ্রামবাসীরা শুকোতে দিয়েছে জামাকাপড়। মন্দিরের পশ্চাদভাগের দেওয়ালে মৈথুনরত নরনারীর রিলিফ, সাধারণ বিষ্ণুমন্দিরের পক্ষে যা অস্বাভাবিকই বটে। সব মিলিয়ে স্থাপত্যকীর্তির এক চরম বিস্ময় এই মন্দির, যদিও খ্যাতি তাকে দেখভালের নিশ্চয়তা দেয়নি।
দেয়নি রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের(প্রয়াণ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ) বাড়িকেও। চারদিক জঙ্গলাকীর্ণ, প্রবেশপথে মানুষের বিষ্ঠা ইতিউতি। দেখে কে বলবে, উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম সম্মানীয় ব্যক্তির বাড়িতে এসে প্রবেশ করেছি আমরা! রমাপতি ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত রচয়িতা, বর্ধমানের রাজার সভাগায়ক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে জানা যায়, কলকাতায় গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ব্রাহ্মসসঙ্গীত শোনাতেন তিনি। রমাপতির খ্যাতি বিস্তৃত ছিল কলকাতা পর্যন্তও। গীতিকার হিসেবেও ফেলনা নন তিনি। ১৮৬৩ সালে বেরোয় তাঁর লেখা ‘মূল সঙ্গীতাদর্শ’ বইটি। এছাড়াও দুর্গাদাস লাহিড়ীর ‘বাঙ্গালীর গান’, অমরেন্দ্রনাথ রায়ের ‘শাক্ত পদাবলী’, ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘শাক্ত পদাবলী’ ইত্যাদি সংকলনেও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর গান। এহেন রমাপতির বিশাল বসতভিটা বর্তমানে গ্রামের মানুষের মলত্যাগের ঠিকানা। দেখে অধোবদন হয়েছি লজ্জায়।
শোনা যায়, রমাপতির বাড়ির বিশাল ঠাকুরদালানে জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা হত একসময়। বাড়ির অন্যপ্রান্তে বসবাসের ঘর। সবই এখন পাঁজর বের-করা ইটের সারি। মাথার ওপরের ছাদ ধসে পড়েছে সর্বত্র। পায়ের সামনে বিষাক্ত সাপের আনাগোনা। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে, যে-কোনো সময় পতনের আশঙ্কা। এতসব ঝুঁকি নিয়েও ঘুরে দেখেছি সেই বাড়ি, আর, হতাশা বেড়েছে বই কমেনি। চাইলে বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে সংরক্ষিত করা যেত বাড়িটি। না-হওয়ার জন্য দায়ী একমাত্র চন্দ্রকোণার অসচেতন নাগরিক, আর কেউ নয়।
চন্দ্রকোণার অসংখ্য অবহেলিত স্থাপত্যের সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করলাম এখানে। যাতায়াতের পথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি এমন আরও অনেক। দেখভাল করার নেই কেউ, সংরক্ষণ তো দূরের কথা। এমনকি, মূল মন্দিরগুলোর বাইরে অন্য-সব মন্দিরের ইতিবৃত্ত নথিভুক্তও নেই কোথাও। চন্দ্রকোণার স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা বই লিখেছেন— কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী, সুদর্শন রায় প্রমুখ, তাঁরাও একটি নির্দিষ্ট স্তরের পরে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালাননি। ফলে, আজও অজানা থেকে গেছে মহু মন্দির-স্থাপত্যের কথা। অথচ চন্দ্রকোণার মতো ঐতিহ্যশালী শহরের সঙ্গে এমনটা না-হলেও চলত।
এখনও যেটুকু ইতিহাস বেঁচে আছে সেখানে, নেহাত কম নয়। তা সংরক্ষণের কাজে এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয়দেরই। কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী প্রায় চার দশক আগেই চন্দ্রকোণায় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি ও স্থাপত্য, মৃৎপাত্র নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্থানীয় সংগ্রহশালা। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁর পরবর্তী সময়ের আর-কেউই এগিয়ে আসেননি সে-কাজে। আমার প্রস্তাব, প্রথমেই প্রত্যেকটি স্থাপত্যের খুঁটিয়ে ছবি তোলা হোক। সরজমিন ক্ষেত্রসমীক্ষা করে নথিভুক্ত করা হোক তাদের ইতিহাস। তারপর সেগুলি রক্ষা করার প্রয়াস। একটি ‘ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ তৈরি করা আশু প্রয়োজন, স্থানীয় উৎসাহী ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে। সেইসঙ্গে দরকার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। প্রত্যেকের মিলিত চেষ্টায় চন্দ্রকোণার হারিয়ে-যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যায় আজও। অদূর ভবিষ্যতে ‘মন্দিরনগরী’ হিসেবে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবেও ভাবা যায় এ-জনপদকে। তবে সেসবের আগে প্রয়োজন ধ্বংস রোধ করা। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সংরক্ষণের পথে এগোনো। নইলে মেদিনীপুর তথা বাংলার ইতিহাসের এক আশ্চর্য নগরী বেঁচে থাকবে শুধু বইয়ের পাতায়। আসুন, আমরা সর্বস্তর থেকে আওয়াজ তুলি এ-বিষয়ে। চেষ্টায় যেন খামতি না-থাকে আমাদের।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
ছবি – তন্ময় ভট্টাচার্য, শুভ্রজিৎ কোলে
বিশেষ কৃতজ্ঞতা – অরিন্দম রায় গোস্বামী, গণেশ দাস
Powered by Froala Editor