মানুষের আগ্রাসনে সংকটে ১০ কোটি বছর আগের ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’

আকৃতি অবিকল কুমিরের মতো। মুখের চোয়ালেও সাজানো করাতের মতো ধারালো দাঁতের সারি। অথচ, তার পা নেই কোনো। বদলে শরীরে রয়েছে সাত-সাতটি পাখনা এবং আঁশের আস্তরণ। কুমির মনে হলেও, আদতে এই অদ্ভুতদর্শন প্রাণী একটি মাছ। অ্যালিগেটর গার। আজ থেকে ন্যূনতম ১০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়েছিল তাদের। তবে বিবর্তন ও অভিযোজনের সূত্রের উল্টোদিকে গিয়ে অপরিবর্তিতভাবেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এই মৎস্য প্রজাতি। আর সেই কারণেই ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ বা ‘লিভিং ফসিল’ (Living Fossil) হিসাবেই বিবেচিত হয় এই প্রাণীটি। এবার মানুষের আগ্রাসনে ক্রমশ অবলুপ্তির দিকে হাঁটছে তারা। সম্প্রতি এমনই তথ্য উঠে এল গবেষণায়। 

‘ট্রান্সাকশন অফ আমেরিকান ফিশারিস সোসাইটি’ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি। গবেষণায় জড়িত ছিলেন লুইসিয়ানার নিকোলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং মৎস্যবিদ সলোমন ডেভিড। তাঁর গবেষণায় উঠে আসছে, ক্রমশ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে অ্যালিগেটর গারের জনসংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক দশকের মধ্যেই পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এই প্রাণীটি। 

অ্যালিগেটর গার মূলত উত্তর আমেরিকার বাসিন্দা। মিসিসিপি নদীর নিম্ন ও মধ্য প্রবাহেই দেখা মেলে তাদের। তাছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও এই প্রাণীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অ্যালিগেটর গার সাধারণত নদীর বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য-খাদক পিরামিডের শীর্ষে অবস্থান করে। অন্যান্য ছোটো মাছ থেকে শুরু করে কচ্ছপ, পাখি, উভচর এমনকি জলজ স্তন্যপায়ীরাও তাদের খাদ্য। আর এই জায়গাতেই তাদের সঙ্গে সংঘাত মানুষের। 

মিসিসিপি নদীতে অ্যালিগেটর গারের উপস্থিতিই মৎস্যজীবীদের লাভের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আজ থেকে প্রায় ন’দশক আগের কথা। ১৯৩০-এর দশকে পথের কাঁটা সরাতেই নির্বিচারে অ্যালিগেটর গার হত্যা করা শুরু করেছিল মার্কিন মৎস্যজীবীরা। সঙ্গে দিয়েছিলেন মিসিসিপির স্টেট ওয়াইল্ডলাইফ ম্যানেজাররাও। ‘টেক্সাস গেম’ এবং ‘ফিস কমিশন’ নামের দুটি মৎস্যজীবী সংস্থা তৈরি করেছিল একধরনের বিশেষ নৌকা। যা ইলেকট্রিক শক ওয়েভের মাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় অ্যালিগেটর গার শিকার করতে সক্ষম। ‘ইলেকট্রিকাল গার ডেস্ট্রয়ার’-খ্যাত সেই নৌকায় মুছে দেয় প্রাগৈতিহাসিক প্রজাতিটির একাংশকে। 

আরও পড়ুন
দ্রুত হারে কমছে হংসচঞ্চুর সংখ্যা, হারিয়ে যাবে এই জীবন্ত জীবাশ্মও?

অবশ্য পরবর্তীকালে মার্কিন বনদপ্তর এই মাছ শিকারকে বেআইনি ঘোষণা করে। তবে আগ্রাসন থামেনি। তার জন্য দায়ী সচেতনতার অভাব। অনেকেরই বিশ্বাস, অ্যালিগেটর গার মানুষের জন্য বিপজ্জনক। ফলত, চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু আদতেও ব্যাপারটা তেমন নয়। অ্যালিগেটর গার মানুষখেকো নয়। এমনকি ভয়াল দাঁতের অস্তিত্ব থাকলেও তারা যেকোনো খাদ্যকেই গিলে খায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মানুষ শিকার করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তবে সে ব্যাপার ওয়াকিবহাল নয় সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি নদীর ওপর ড্যাম ও অন্যান্য নির্মাণকার্যের জন্যও বিপর্যস্ত এই বিশেষ প্রজাতিটির অস্তিত্ব। 

আরও পড়ুন
জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল আলেকজান্ডারকে? ঐতিহাসিকদের গবেষণায় উঠল প্রশ্ন

এমতাবস্থা এই প্রজাতির অবলুপ্তি রোধ করতে একমাত্র কৃত্রিম প্রজননই হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞানীদের কাছে। এমনটাই অভিমত সলোমন ডেভিডের। তবে সেই কাজ খুব একটা সহজ নয়। কৃত্রিম অঞ্চলে এই প্রজাতির প্রজননের অনুকূল বাস্তুতন্ত্র তৈরি করাই মূল চ্যালেঞ্জ গবেষকদের কাছে। তা আদৌ কতটা সম্ভব তা নিয়ে থেকেই যাচ্ছে সংশয়…

আরও পড়ুন
জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য হাঙর – আশ্চর্য দৃশ্য সলোমন দ্বীপে

Powered by Froala Editor

Latest News See More