‘দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও’।
সর্বভারতীয় বেতার মাধ্যমে ইংরাজি ভাষায় ব্রডকাস্টিং-এর আগে এতদিন পর্যন্ত শোনা যেত এই ঘোষণা। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে মুছে গেল সর্বভারতীয় বেতারের এই ব্রডকাস্ট। গত ৩ মে বুধবার, ডিরেক্টর জেনারেলের কার্যালয় থেকে স্যাটেলাইট বার্তায় জানানো হয় এবার থেকে বন্ধ হবে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ (All India Radio) কথাটির ব্যবহার। পরিবর্তে সর্বভারতীয় বেতারের সমস্ত কর্মীদের ঘোষণার ব্যবহার করতে হবে ‘আকাশবাণী’ (Akashvani) শব্দটি।
‘আকাশবাণী’ কোনো নতুন শব্দ নয়। ইংরাজি বাদ দিয়ে বাংলা, হিন্দি, সাঁওতালি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারের সময় ব্যবহৃত হয় ‘আকাশবাণী’ শব্দটিই। কেবলমাত্র ইংরাজি ভাষায় প্রচারের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হত ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’। তাছাড়াও সর্বভারতীয় বেতার পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক নামও ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’। এবার থেকে আইনিভাবে সেটিও পরিচিত হবে ‘আকাশবাণী’ নামে, নির্দেশ সরকারের।
সরকারের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণ কী? বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রিটিশ অর্থাৎ ঔপনিবেশিক সময়ের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়ে চলেছে কেন্দ্র সরকার। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-র নামবদলের ক্ষেত্রেও সেই দিকটাকেই মাথায় রাখা হয়েছে বলেছে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। যদিও স্পষ্টভাবে সে-ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনো বয়ান আসেনি তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের কার্যালয় থেকে।
অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশি নন রেডিও-কর্মীদের একাংশ। আসলে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ নামটিতেই ভারতীয় বেতার মাধ্যম পরিচিত হয়েছে প্রায় নব্বই বছর। সেদিক থেকে ‘আকাশবাণী’ নামটি তুলনামূলকভাবে অর্বাচীন। ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে রেডিও প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯২৭ সালে। প্রথমে বোম্বে, তারপর কলকাতায় শুরু হয় বেতার পরিষেবা। সে-সময় এই পরিষেবা প্রদান করত ‘ব্রডকাস্টিং কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া’-খ্যাত একটি বেসরকারি সংস্থা। ১৯৩০ সালে যা অধিগ্রহণ করে ভারত সরকার। নাম রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। পরবর্তীতে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর পরামর্শে এই নাম বদলে রাখা হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৌজন্যে ‘আকাশবাণী’ শব্দটি সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৩৯ সালে। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-র অফিস উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে না পেরে একটি বার্তা পাঠান তিনি। সেখানেই ব্যবহৃত হয় ‘আকাশবাণী’। পরবর্তীতে তাঁর কবিতাতেও বেতার অর্থে ব্যবহৃত হয় ‘আকাশবাণী’। যদিও রবীন্দ্রনাথের আগেই এই শব্দের ব্যবহার করেছিলেন সুকুমার রায়। এমনকি ১৯৩৫ সালে মহীশূর বা মাইসোরে স্থাপিত হয়েছিল ‘আকাশবাণী’ নামের একটি বেতারকেন্দ্র।
এর প্রায় দু’দশক পর ‘আকাশবাণী’ নামটির প্রবেশ ঘটেছিল সর্বভারতীয় বেতারের মূলধারায়। ১৯৫৬ সাল। আঞ্চলিক ভাষায় ব্রডকাস্টিং-এর জন্য ‘আকাশবাণী’ নামটিকে বেছে নেন তৎকালীন ডিরেক্টর বিভি কেশকার। কিংবদন্তি বেতার ব্যক্তিত্ব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বয়ান অনুযায়ী, ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশবাণী’ কবিতাটিই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল এই নামবদলের কারণে। যদিও মূল প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেননি তিনি। এতদিন পর্যন্ত দুটি নামই ব্যবহৃত হত সমান্তরালভাবে।
ঠিক এই জায়গাতেই প্রশ্ন তুলছেন বেতারকর্মীদের একাংশ। কতটা প্রয়োজন ছিল ঐতিহ্যবাহী, প্রায়-শতাব্দীপ্রাচীন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ নামটির আইনি বদলের? পাশাপাশি ঔপনিবেশিক চিহ্ন মুছে ফেলাই যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তবে ‘বিবিধভারতী’-র মূল সংস্থা ‘কমার্সিয়াল ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ নামটিরই বা বদল করা হল না কেন তবে? যেখানে এই নামটিও সরাসরি প্রদান করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। এমনকি এর আগে এই নামটি বদলানোর জন্যও একাধিকবার সরব হয়েছিল বেতারকর্মীদের একাংশ। সবমিলিয়ে সরকারের এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তে খুশি নন অনেকেই।
Powered by Froala Editor