আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। মধ্য কলকাতার এক ব্যস্ত রাস্তা। অবশ্য শুধু এটুকু বললে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে পশ্চিমবঙ্গ চিনেছে অন্যভাবে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। এই ৩১ নং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেই রয়েছে রাজ্য বামফ্রন্টের সদর দপ্তর। যেখানে বসে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর রাজ্য-রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন বামফ্রন্ট নেতৃবর্গ। এ তো গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রাথমিক পরিচয়। কিন্তু কে এই আলিমুদ্দিন? সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে।
ঢাকার জমাদার লেন। একটা সরু অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গলি। দিনের বেলায় কতটুকু সময় সে রোদের মুখ দেখে তা বোঝা দায়। এই জমাদার লেনেই ১৮৮৪ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে জন্ম নিলেন স্বাধীনতা যুগের এক অগ্নিপুরুষ, সৈয়দ আলিমদ্দিন আহম্মদ। বাবা আমিরুদ্দিনের ছিল সামান্য এক দর্জির দোকান। সংসার-সীমান্তে যুদ্ধরত বাবাই ছিলেন আলিমদ্দিনের অনুপ্রেরণা। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল মানুষের যাপন। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন তখন পুরোদমে জ্বলছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা। স্বাভাবিক ভাবেই পাল্টে যাওয়া সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল সমাজ অর্থনীতি এবং বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র। কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হল জাতীয় কংগ্রেস। শুরু হল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ফলে প্রতিদিনই নতুন করে উতপ্ত হয়ে উঠছিল দেশীয় রাজনীতি। পরিবর্তিত সময়ও নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছিল যুবক আলিমদ্দিনকে। যদিও তার বহু পূর্বেই সময় তার দাগ রেখে গেছে আলিমদ্দিনের ব্যক্তিগত জীবনেও। ঘটে গেছে এক অনাকাঙ্খিত বিপর্যয়। মারা গেছেন আলিমদ্দিনের বাবা। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আলিমদ্দিনকে নিতে হয়েছে প্রাইভেট টিউটরের জীবিকা।
জীবনের এই সমস্ত ভাঙাগড়ার খেলাকে পাথেয় করেই পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেন যুবক আলিমদ্দিন। ঘটনাচক্রে হেমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন এই আলিমদ্দিনের বন্ধু। এই হেমচন্দ্রই স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আলিমদ্দিনকে।
সাল ১৯০৫। ইতিহাসের পাতা বলছে সময়টা উত্তাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। ইংরেজ সরকারের দমননীতির গ্রাফ প্রতিদিনই ঊর্ধ্বমুখী। এমন সময় বিপ্লবী হেমচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন এক গুপ্তসমিতি। যার অন্যতম সভ্য ছিলেন এই আলিমদ্দিন ওরফে মাস্টারসাহেব। তাঁর নেতৃত্বে যুবকদের শারীরিক কসরতের জন্য বেশ প্রতিষ্ঠিত হল বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। বস্তুতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই চলত বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এমনকি স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করার প্রাথমিক পাঠও দেওয়া হত এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই। না এখানেই থেমে থাকেননি মাস্টারসাহেব। একের পর এক বিপ্লবীকে প্রয়োজনীয় শেল্টার দিয়েছেন। সাহায্য করেছেন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। বিপ্লবের কাজে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য করার জন্য আলিমদ্দিন গঠন করেছেন স্বদেশি ডাকাতদল। সেই যুগেই পুঁজিপতিদের ত্রাস হয়ে উঠেছিল তারা। ইংরেজ সরকারের দমননীতির ফলে হেমচন্দ্র সহ একাধিক নেতা যখন জেলে, তখনও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অক্সিজেন জুগিয়েছেন আলিমদ্দিন। নিজে ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। সেই সূত্রেই সম্রদায়িকতাকে কোনোদিন প্রশ্রয় দেননি তিনি। ছদ্মবেশে একের পর এক বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। এমনকি পুলিশি ধরপাকড়ের কারণে আত্মগোপন করেও চালিয়ে গেছেন ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ কোনোদিন তার টিকিও স্পর্শ করতে পারেনি।
সাল ১৯২০। যক্ষ্মা রোগে বেশ কিছুদিন ভোগার পর চলে গেলেন মাস্টারসাহেব। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে মধ্য কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করা হল 'আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।' খানিক বিকৃতই হল ‘আলিমদ্দিন’ নামটি। মাস্টারসাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বর্ণময় অধ্যায়। এমনই কতশত বিপ্লবী আমাদের চোখের আড়ালে কাজ করে গেছেন। ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি। আমরা কি তার হিসেব রেখেছি?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রথম রেলপথের পরিকল্পনা করেছিলেন দ্বারকানাথ, আমরা কি মনে রেখেছি সেই কথা?