ডাফ সাহেবের মুক্তচিন্তায় বিরক্ত রক্ষণশীল বাঙালি, জন্ম নিল নতুন শব্দ – ‘ডেঁপো’

মানিকতলা মোড় থেকে যে রাস্তাটা বিধান সরণীর দিকে যাচ্ছে, একটু ফাঁক পেয়ে সেদিকেই ঢোকা গেল। বেশ খানিকটা এগিয়েই একটা রাস্তা ডানদিকে বেঁকে গেছে। শিশির ভাদুড়ী সরণী। এখানের ১২৭ নম্বর ঠিকানাই আমাদের গন্তব্যস্থল। সামনেই হাজির হবে খুবই সাধারণ চেহারার একটি গির্জা। সেরকম রূপ নেই, চেহারায় আভিজাত্য নেই। অথচ এমন গির্জার সঙ্গেই জুড়ে আছে শহরের ‘স্কটিশ’ ইতিহাস। জড়িয়ে আছেন এক পাদ্রি, তাঁর কাজ, এবং একটি শব্দ— ‘ডেঁপোমি’…

গির্জা থেকে সরে পিছিয়ে যাওয়া যাক ১৯০ বছর আগের কলকাতায়। বিদেশিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। পলাশির মাঠে ব্রিটিশদের গরিমা দেখানোও হয়ে গেছে। ইংরেজরা মুখ্য জায়গা ধরে রাখলেও, অন্যান্য দেশ থেকেও লোকেরা আসতে থাকল কলকাতায়। এমন সময় ১৮৩০ সালের মে মাসে শহরে পা রাখলেন এক স্কটিশ যুবক— আলেকজান্ডার ডাফ। ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য স্কটল্যান্ডের চার্চের সংগঠন তাঁদের প্রথম দূত হিসেবে এই তরুণকেই বেছে নিয়েছিলেন। 

শিক্ষিত, ধার্মিক, সেইসঙ্গে মুক্তমনা ডাফ এমন একটা সময় কলকাতায় এসেছিলেন, যখন শহরে সমাজ সংস্কারের ঢেউ এসেছে। ইংরেজি শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী ভাবধারা এক ধাক্কায় যেন কুসংস্কারের মূলে আঘাত হানল। মনে রাখতে হবে, এটা এমন একটা সময় যখন কলকাতাও তার ‘শহুরে’ চেহারা পুরোপুরি তৈরি করে উঠতে পারেনি। এবং সাহেব-মেমদের আগমনে অবধারিতভাবে চলে এল সনাতন ধর্ম রক্ষার তাগিদ। এতকিছুর মধ্যেও সতীদাহ রদ হল। হিন্দু কলেজ তৈরি হল। ডেভিড হেয়ার, ডিরোজিও’র মতো মানুষরা যুক্তিবাদী চিন্তা ও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছেন। আর সেই সারণীতেই হাজির হলেন আলেকজান্ডার ডাফ। 

ডাফ সাহেব ঠিক কী কী করেছিলেন, সেই সম্পর্কে অনেক ইতিহাস লেখা হয়েছে। এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজই তাঁর অন্যতম উদাহরণ। সেইসঙ্গে চেষ্টা করছিলেন, সমাজের তরুণদের মধ্যে যাতে বিজ্ঞানচেতনা, ইংরেজি শিক্ষা এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ছড়িয়ে যায়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় যেমন ব্রিটিশ সরকারেরও সমালোচনা করেছেন, তেমনই নীল চাষিদের দুর্দশার সময় তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় এসে দেখেছিলেন, এখানকার গির্জায় ভারতীয়দের ঢুকতে দেওয়াই হয় না। এমনকি, খ্রিস্টান হলেও নয়। এটা তো হওয়া উচিত নয়! ডাফ নিজে উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করলেন একটি গির্জা, যেখানে বাঙালিরাই এসে প্রার্থনা জানাবেন। তারই নাম পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ডাফ চার্চ’। ঠিকানা? ওই যে, শুরুতেই বললাম… 

ডিরোজিও’র শিষ্যদের সঙ্গে রীতিমতো সদ্ভাব ছিল ডাফ সাহেবের। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনিই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। এবং সেই সময় তাঁদের ক্রিয়াকর্মের কথা আজও ইতিহাসের পরতে পরতে লেখা আছে। উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন সমাজের অতি-রক্ষণশীল ভাবমূর্তিকে আঘাত করা। সেসব যাতে মুছে যায়, তারই চিন্তাভাবনা করা হত। কিন্তু সমাজ সংস্কার যত বাড়তে লাগল, ততই ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করতে লাগল সমাজের তালেবররা। এভাবে যে সমস্ত ‘সংস্কৃতি’ রসাতলে যাচ্ছে! এই ‘ম্লেচ্ছ’ সাহেবরাই যত নষ্টের মূল। ছেলেপিলেদের মাথা নষ্ট করছে। অগত্যা, তাঁরাও পাল্টা দিতে আরম্ভ করল। 

আলেকজান্ডার ডাফ এবং তাঁর শিষ্য-ছাত্ররাও এই আক্রমণ থেকে বাদ যেত না। ডাফের ‘চেলা’দের জন্য বঙ্গসমাজে তৈরি হল নতুন একটি শব্দ - ‘ডেঁপো’। এবং সেখান থেকেই ‘ডেঁপোমি’। ডাফের সঙ্গে ডেঁপোর মিলটা লক্ষ্য করেছেন। স্বভাবতই একটা সময় ব্যঙ্গ করেই বলা হত। কালে কালে বাঙালির অভিধানে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ‘ডেঁপো’। ডাফ সাহেব চলে গেছেন সেই কবে! স্কটল্যান্ডে তাঁর কবরের ওপর নরম সবুজ ঘাস খেলা করছে। তাঁর ছাত্ররাও ইতিহাসের রাস্তায় হারিয়ে গেছে। অথচ টিকে রইল ‘ডেঁপোমি’। ১২৭, শিশির ভাদুড়ী সরণীর ‘ডাফ গির্জা’-র দিকে তাকালে সেই ইতিহাসগুলোই কি ফিরে ফিরে আসে সামনে? সময় কিছু চিহ্ন ঠিকই রেখে যায়… 

আরও পড়ুন
কমলকুমারের কাছে ফরাসি শেখার ‘অত্যাচার’, দু’মাসেই হাল ছাড়লেন সুনীল

তথ্যসূত্র- ‘স্কটিশ সাহেব, বাঙালি গির্জা আর ‘ডেঁপোমি’র আখ্যান’, সুরমিতা কাঞ্জিলাল, বঙ্গদর্শন 

Powered by Froala Editor

More From Author See More