“রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন আশ্রমের কাজে মহিলাদের কল্যাণস্পর্শ পেলে তা পূর্ণতা অর্জন করবে। তাঁর সভাপতিত্বেই ১৯১৬ সাল থেকে শুরু হল আলাপিনী মহিলা সমিতির পথচলা। প্রতিমা দেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ হেমলতা দেবী, ক্ষিতিমোহন সেনের পত্নী কিরণবালা দেবী ছিলেন সেই সময়ের উদ্যোক্তা। সমিতির নামকরণ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিয়মিত হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে লক্ষ রাখত সমিতি। নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। সমিতিকে আশ্রমের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা হিসাবে তো দেখা হয়নি কোনোদিন।” বলছিলেন আলাপিনী মহিলা সমিতির বর্তমান সম্পাদিকা জয়তী ঘোষ। ক্ষোভ ও দুঃখের ছাপ গলায় স্পষ্ট। ১০ ডিসেম্বর ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’-কে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যে ‘নতুন বাড়ি’-র ঘরটি খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
১০৪ বছরের প্রাচীন সংগঠন ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’। সদস্য বলতে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী, শিক্ষিকা বা প্রাক্তনীরা। সমিতির বর্তমান সভানেত্রী অপর্ণা দাস মহাপাত্র জানালেন, “কিছুদিন আগেই একটি বৈঠকে উপাচার্য প্রশ্ন করেন আমরা ঘর ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিই না কেন। আমরা জানাই, এর আগে কোনো উপাচার্য ভাড়া দেওয়ার কথা বলেননি। তবে আমাদের সাধ্য মতো ভাড়া দিতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু এই কথার কোনো জবাব আমরা পাইনি। তার বদলে পেলাম ঘর খালি করার নোটিশ।” ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে নোটিসে জানানো হয়, পাঠভবন এবং আনন্দ পাঠশালার কাজের জন্য ঘরটি প্রয়োজন। এই বিষয়ে সমিতির সদস্যারা জানাচ্ছেন, মাসে মাত্র দুদিন, ১৫ এবং ৩০ তারিখ বিকালে ঘরটি ব্যবহার করেন তাঁরা। ঘরের একটি চাবি রাখা থাকে পাঠভবনের অধ্যক্ষার কাছেও। আর আনন্দ পাঠশালা তো ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’-র উদ্যোগেই তৈরি। তার জন্য সবরকম সাহায্য করতে তাঁরা প্রস্তুত।
১৯১৬ সালের পর থেকে নানা জায়গায় বৈঠক বসত সমিতির। ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। তখন থেকে তাঁর বৈঠকখানাতেই সভা বসত। এরপর ১৯৫৬ সালে ইন্দিরা দেবী উপাচার্য হলে তিনিই নতুন বাড়ির এই ঘরটি সমিতিকে ব্যবহার করতে দেন। এরপর থেকে সমস্ত উপাচার্যই সমিতির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। সেখানে বর্তমান উপাচার্যের এমন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ সকলেই। সম্পাদিকা জয়তী ঘোষের কথায়, “আমাদের প্রত্যেকেরই বয়স ষাটের উপরে। আন্দোলনের রাস্তায় যাওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাও নেই। কিন্তু উপাচার্যের এমন ব্যবহারে আমরা সত্যিই অপমানিত। আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি। এই পরিস্থিতিতে আমরা আশ্রমের সদস্যদের এবং সমস্ত শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য চাই।” বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুধী রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, “নতুন বাড়ি, আলাপিনী মহিলা সমিতি সবই আশ্রমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এগুলোকে বাদ দিতে গেলে আসলে একটা ইতিহাসকে মুছে ফেলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সেটা খুব সুখকর হবে না।” এরপরেও কি কোনো ধরনের ইতিবাচক আলোচনার দিকে যাবেন উপাচার্য? সময় তো আর মাত্র একদিন।
Powered by Froala Editor