এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য অ্যাশট্রে তৈরি করে দিলেন দালি, বদলে চাইলেন একটি শিশু হাতি

কথায় বলে, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা। কখনও চ্যাপলিন বা হিটলারের গোঁফ, কখনও রাজা-রাজড়াদের পুরুষ্টু ভারী গোঁফ— এক একজনের এক একরকম বাহার। আরেকজনের নাম বলা হল না। এই গল্পটি তাঁকে নিয়েই। তাঁর মতো দেখতে মুখোশ পরে ব্যাঙ্ক লুটপাট করা হল; আর আমরা সিনেমায় সেসব গোগ্রাসে গিললামও। এইরকম ‘কাল্ট’ হয়ে ওঠা মানুষটির নাম নয়, পদবিই যথেষ্ট— দালি! সাররিয়ালিজমকে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন এই স্প্যানিশ ভদ্রলোক। আঁকা তো বটেই, সালভাদর দালি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর ‘ইউনিক’ তরোয়াল গোঁফের জন্যও। তবে এই গল্প গোঁফ নিয়ে চুলোচুলি করার জন্য নয়। এখানে দালির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি হাতি, অ্যাশট্রে আর এই দেশ, ভারতবর্ষ…

গল্পটা শুরু হোক এয়ার ইন্ডিয়ার হাত ধরে। সাল ১৯৬৭। সেই সময় ভারতের অন্যতম প্রধান এই বিমান সংস্থাটি নিজের পরিষেবার জন্য বিখ্যাত তো ছিলই, আরও একটা জিনিস একে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। ওই সময় এয়ার ইন্ডিয়ার নিজস্ব একটি আর্ট কালেকশন ছিল। ছোটখাটো নয়, বেশ বড়ো ও দুর্মূল্য সেই কালেকশন। দেশ-বিদেশের নানা শিল্পীর কাছ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করত সেসব। আর সেই সূত্রেই নজরে পড়লেন সালভাদর দালি। ওই সময় দালি রীতিমতো বিখ্যাত; নিজের সাররিয়াল দৃষ্টি দিয়ে সময়কে ধরছেন তিনি। ঠিক করা হল, তাঁর কাছেই যাওয়া হবে এবার…

যেমন ভাবা তেমনই কাজ। এয়ার ইন্ডিয়ার তরফ থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়া হল। তখন সেখানেই রয়েছেন দালি। তার কাছে আবেদন জানানো হল, তিনি যদি কিছু একটা দেন এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য। দালি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ভারত সম্পর্কে নিশ্চয়ই কৌতূহল ছিল তাঁর। তৈরিও করলেন একটি বিশেষ জিনিস। ছবি নয়, একটি অ্যাশট্রে। সাদা রঙের, ছোট্ট মতন।

কিন্তু দালি বানিয়েছেন, কাজেই সামান্য জিনিস তো হবে না! সেখানেও ছোঁয়া রয়েছে সিগনেচার সাররিয়ালিজমের। মূল ছাইদানিটি একটি সাদা শঙ্খ বা ঝিনুকের মতো। তাকে ঘিরে আছে একটি নীল সাপ। আর অ্যাশট্রের স্ট্যান্ডে একসঙ্গে রয়েছে হাতি এবং হাঁস। দালির ভাষায়, ‘ডাবল ইমেজ’। প্রথমে দেখে মনে হবে, হাতির দুটো পা আর শুঁড়। আবার ওই শুঁড়টাকেই কখনও মনে হবে রাজহাঁসের গলা। এইরকম প্রায় ৫০০টি অ্যাশট্রে শুধুমাত্র এয়ার ইন্ডিয়ার জন্যই তৈরি করে দেন দালি। কোনো বিমান সংস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা আর্টওয়ার্ক এই প্রথম।

কিন্তু এমনি এমনি তো নিশ্চয়ই তৈরি করা হবে না। যোগ্য মূল্যও তো দিতে হবে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দেন সালভাদর দালি। কোনো অর্থমূল্য নয়, এর বিনিময়ে তিনি চান একটি শিশু হাতি! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। একটি হাতিই চেয়েছিলেন তিনি। এয়ার ইন্ডিয়ার কর্তারাও হতবাক হয়ে যান। তারপরই শুরু হয় ছোটো হাতি জোগাড় করার কাজ। শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্গালোরের চিড়িয়াখানা থেকে ওইরকম বছর দুয়েকের একটি হাতি পাঠানো হয় স্পেনে। প্রথমে জেনেভা, তারপর সেখান থেকে স্পেনের কাদাকুয়েসের (কাতালুনিয়া) উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দালির কাছে পৌঁছনোর পর গোটা কাদাকুয়েস শহর উৎসবে মেতে ওঠে। হাতিকে নিয়ে নগর পরিক্রমা করা হয়; এমনকি সেখানকার প্রশাসন তিন দিনের ছুটিও ঘোষণা করেন! ভারত থেকে দালির জন্য হাতি উপহার আনা হয়েছে, এমন জিনিস উদযাপন না করলে হয়!

সালভাদর দালি শিল্পী মানুষ। তাঁর চিন্তা ভাবনাও সেই স্তরের। তাঁর স্বপ্ন ছিল, এই ছোট্ট হাতির পিঠে চেপে আল্পস পর্বতে যাবেন। সেখানে ঘুরবেন। কিন্তু তাঁর বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়। হাতিটিও আর ছোটো থাকে না। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বার্সেলোনার চিড়িয়াখানায় জায়গা পায় দালির হাতি।

আর ওই অ্যাশট্রেগুলো? প্রায় ৫০০টির মধ্যে বেশ কিছু এয়ার ইন্ডিয়া তাঁদের কয়েকজন বিশেষ গ্রাহকদের দিয়ে দেয়। অনেকগুলোরই আজ কোনো ঠিকানা নেই। কোথায় আছে, কেউ জানে না। তবে কিছু উদ্ধার করা গেছে। এভাবেই এখনও টিকে আছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনার টুকরো।

More From Author See More