১৯৭৫ সাল। ১৫ আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনই বাংলাদেশে ঘটে গেল এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হল তাঁর আবাসনেই। তবে তাঁর দুই কন্যা হাসিনা এবং রেহানা তখন বিদেশে। পশ্চিম জার্মানিতে। হাসিনার স্বামীর ওয়াজেদ মিয়াঁ তখন পারমাণবিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জার্মানিতে। মৃত্যুর থাবা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিরাপদ ছিল না জার্মানিও। বন্ধ বাংলাদেশে ফেরবার রাস্তাও। কঠিনতম অনিশ্চয়তার মধ্যেই ভারতের সাহায্যের হাত পেয়েছিলেন হাসিনা। তাঁকে দিল্লির বাড়িতে আশ্রয় দিলেন ‘প্রণবদা’।
পরবর্তীতে দিল্লির পান্ডারা রোডের বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন শেখ হাসিনা। ছিলেন প্রায় ছ’বছর। একদিকে যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনদেশে এসে থাকা, তেমনই হত্যাকাণ্ডের এক প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা। এই সবকিছুর মধ্যেই দিল্লির নিভৃতবাসে তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন শেখ হাসিনার কাছের ‘বৌদি’। সেই অস্থির সময়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগী করে নিতেন তাঁর ‘বৌদি’। গানে, কবিতায়, সাহিত্যে তাঁদের সঙ্গ দিত রবীন্দ্রনাথ।
গতকাল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়েই দুঃখ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্কের পিছনে চিরকালই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যে অদৃশ্য অস্তিত্ব ছিল, তা জানান তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেও প্রতিবেশী দেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তখন ভারতের রাজ্যসভার অন্যতম সদস্য প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সাহায্যের জন্য সরব হন তিনি। শুরু হয় আন্দোলন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকটতম সংসদ হয়ে ওঠেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালে তাঁর উদ্যোগেই বাংলাদেশের কাছে সামরিক সাহায্য পাঠায় ভারত।
হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়াঁ দীর্ঘদিন দায়িত্ব সামলেছেন দিল্লির অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বারবার হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিষেধাজ্ঞা ফলে দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। ।
আরও পড়ুন
কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত প্রণব; বাংলার বুকেই তৈরি করেছিলেন নতুন রাজনৈতিক দল
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। তাঁর দেশে ফেরা আটকাতে পারেননি রাষ্ট্রপতি রহমান। আটকাতে পারেননি বিরোধী দলের উত্থানকে। ৮১ সালেই দিল্লি ছেড়ে বাংলাদেশে বাসস্থান বদল করেন শেখ হাসিনা। তবে তারপরেও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগে অবধি তাঁদের সম্পর্ক ছিল অটুট।
দিল্লিতে প্রশাসনিক কাজে এসেও বারবার হাসিনা ছুটে গেছেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কোনোরকম প্রতিরক্ষা সূচি ছাড়াই। প্রণব-দম্পতি এতটাই ভরসার ছিলেন তাঁর কাছে। ২০১৫ সালে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্যেও তাই সমস্ত কাজ ফেলেই হাজির হয়েছিলেন হাসিনা।
আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী হলে, 'শ্রেষ্ঠ' হতেন তিনিই? প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ দশকের রাজনীতি
২০১৩ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা’-য় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভূষিত করে হাসিনা সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টরেট অফ ল’ ডিগ্রিতে সম্মানজ্ঞাপন করে তাঁকে। পরবর্তীকালেও বারবার বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণব-স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়িও ছিল বাংলাদেশের নড়াইলে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। তাই যতবার বাংলাদেশে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, পেয়েছেন ‘জামাই’-আদর। শঙ্খধ্বনি, আরতিতে বাংলাদেশ বরণ করেছে তাঁকে।
২০১৯ সালেও বাংলাদেশ বইমেলায় বিশেষ অতিথি হিসাবে হাজির হয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর কাছে বিদেশভ্রমণ বলতে কেবলমাত্র বাংলাদেশই। ভারতের বাইরে কেবলমাত্র বাংলাদেশেরই আমন্ত্রণ কখনো এড়িয়ে যেতে পারেননি তিনি।
শেখ হাসিনার কাছে শুধুমাত্র কাছের মানুষই ছিলেন না প্রণব, ছিলেন একজন অভিভাবকসম পিতৃচরিত্র। প্রতিবেশী দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদ এভাবেই তাই স্বজনহারানোর ব্যথা হয়ে ওঠে হাসিনার কাছে। ছাপ রেখে যায় তাঁর ব্যক্তিত্বের...
Powered by Froala Editor