১০০-য় পা দিল বেঞ্জামিন ক্রিস্টেনসেনের হরর ডকুমেন্টারি ‘হ্যাক্সান’

১৯২২ সাল। অদ্ভুত এক নাট্যমঞ্চায়নের সাক্ষী হয়েছিল জার্মানির বার্লিন শহর। মানুষের মনে আতঙ্কের বীজ বুনে দিয়েছিল সেই নাট্য উপস্থাপনা। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে নসফেরাতু নিয়েই। তবে ওই একই বছর ইউরোপেই মুক্তি পেয়েছিল আরও একটি ঐতিহাসিক হরর সিনেমা। অবশ্য সিনেমা না বলে সুইডিস চলচ্চিত্রটিকে ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রই বলা শ্রেয়। ‘হ্যাক্সান : হুইচক্রাফট থ্রু দ্য এজেস’ (Haxan : Witchcraft Through The Ages)। ১৯২২ সালে নির্মিত এই সিনেমা সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল হরর জঁরের সংজ্ঞা। নসফেরাতুর (Nosferatu) মতো এই ছবিও এবার পা দিল ১০০ বছরে। 

আতঙ্কও একধরনের বিনোদন। আর সেই কারণেই, আজও সুপারহিট ছবির তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেয় ‘ইট’ কিংবা ‘কনজিউরিং’-এর মতো সিনেমারা। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও চলচ্চিত্রজগতের সামগ্রিক আবহ ছিল একইরকম। মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসত তখনও। তবে দর্শকদের আতঙ্কিত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না ড্যানিস পরিচালক বেঞ্জামিন ক্রিস্টেনসেনের। বরং, তিনি সিনেমার পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন শতাব্দীপ্রাচীন ঘৃণ্য এবং অমানবিক কালাজাদু ও ডাইনি-তত্ত্বের নানান রীতি-রেওয়াজকে। ভয়ের পরিবেশ, দৃশ্যায়ন ও এক্সপেরিমেন্টেশনই এই ছবিকে করে তুলেছিল তৎকালীন সময়ের অন্যতম ভয়ের সিনেমা। বেঞ্জামিনের ভাষায় বলতে গেলে, এই সিনেমায় কোনো ধারাবাহিক গল্পের প্লট নেই। 


হ্যাঁ, বেঞ্জামিনের দাবি এতটুকু ভুল নয়। ঐতিহাসিক ‘হ্যাক্সান’ পারতপক্ষে ইউরোপের অন্ধকার সংস্কৃতির উপর একটি ঐতিহাসিক বক্তৃতা। এমনকি এই সিনেমার শুরুও হয়েছে কালাজাদু এবং শয়তান-আরাধনার ওপর বক্তৃতা এবং কিছু নথি প্রদর্শন দিয়ে। সাত খণ্ডে বিভক্ত এই ছবির দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে ধীরে ধীরে দেখানো হয়েছে নিষিদ্ধ জাদুবিদ্যার নানান উপাচার। সেখানে বাস্তব ভিডিও ক্লিপিং-এর সঙ্গে কোথাও কোথাও মিশে গেছে পরিচালকের কল্পনা এবং অতিপ্রাকৃতিক ভিস্যুয়াল এফেক্ট। শিশু বলি, শয়তানের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কিংবা ডাইনি অপরাধে অভিযুক্ত মহিলাদের নির্মম শাস্তি— অস্বস্তিকর দৃশ্য বুনে বুনেই এই কোলাজ নির্মাণ করেছেন পরিচালক। 

দর্শকদের মনে আতঙ্কের জাল বোনাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না বেঞ্জামিনের, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিনেমার শেষ অধ্যায়ে এসে। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং নিষিদ্ধ অনুশীলনগুলির মধ্যে দিয়েই আধুনিক মনস্তত্ত্বের একটি দিক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন বেঞ্জামিন। দেখিয়েছিলেন,  এই হিংসাত্মক আচার কোথাও গিয়ে অনুশীলনকারীদের কাছেও মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আদালত কিংবা পোপের কাছে গিয়ে নিজেই স্বীকারোক্তি করেন অনেকে। হিংসাপ্রবণতা এবং এই অপরাধবোধ মাঝে অবিরাম ঘটে চলা মনস্তাত্ত্বিক দোলাচলেই ফোকাস করেছিলেন তিনি। 

নসফেরাতুর মতো ‘হ্যাক্সান’ নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। বিশ্বের বহু পরিচালকই দাবি করেছিলেন এই ছবি জনসাধারণকে দেখানোর যোগ্য নয়। অর্থাৎ, প্রচ্ছন্নভাবে থিয়েটার থেকে এই ছবি সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিল বহু স্তরে। যদিও তেমনটা হয়নি। বরং, পঞ্চাশের দশকে পরিচালক এই ছবির কপিরাইট পুনর্নবীকরণ করতে ব্যর্থ হলে, তা চলে আসে পাবলিক ডোমেইনে। পরবর্তীতে এই ছবির বিভিন্ন চিত্রাংশ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও চালিছেন বহু পরিচালক। যেমন, ১৯৬৮ সালেই ব্রিটিশ পরিচালক অ্যান্থনি বালেচার নতুন করে সম্পাদনা করেন এই তথ্যচিত্রের। পাশাপাশি ‘হ্যাক্সান’-এর নির্মাণ কিংবা দৃশ্যায়ন কৌশল আজও অনুপ্রাণিত করে চলেছে আধুনিক হরর সিনেমাকে।

আজ পরিস্থিতি বদলেছে। কালাজাদুর অনুশীলন পৃথিবীজুড়ে হয় না বললেই চলে। সেখানে দাঁড়িয়ে এই ছবির বার্তা খানিক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে আজকের জগতে। বরং, আজকের সময়ে ‘হ্যাক্সান’ যেন এক অন্ধকার ইতিহাসের ধারাভাষ্য… 

Powered by Froala Editor