৭৩ বছর পর পুনর্মিলন, দেশভাগের সময় হারানো পরিবার ফিরে পেলেন বৃদ্ধা

১৯৪৭ সাল। দীর্ঘ ১৯০ বছর পরে স্বাধীনতা মিলেছিল ঠিকই। কিন্তু দেশের বুকের ওপরে বসে গিয়েছিল কাঁটাতারের দাগ। সেই দাগ ঘিরেই অবিরত রক্তক্ষয়। ভিটেমাটি ছেড়ে মাথাগোঁজার একচুল জমির জন্যই পাড়ি দেওয়া অন্যত্র। সেই পরিযায়নই কারোর থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয়জনদের। কারোর থেকে কেড়ে নিয়েছে শেষ সম্বলটুকুও। যে ক্ষতস্থান আজও দগদগে বহু মানুষের মনে। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পেরিয়ে এসেও। তবে এতদিন পরে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে পুনর্মিলনের সুযোগ করে দিল হোয়াটসঅ্যাপ এবং ডিজিটাল মাধ্যম। একেবারে রূপকথার মতোই...

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শহত মাইলসি। সেই শহরই বর্তমান ঠিকানা ৮৬ বছর বয়সী ডাফিয়া বাই ওরফে আয়েশা বিবির। তবে ছোট থেকেই এই শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা নয়। এই শহরে এসে পড়ার সঙ্গেও জুড়ে রয়েছে এক দগদগে স্মৃতি। সদ্য পেরিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সেই স্মৃতির কথাই উল্লেখ করে এক উর্দু সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন লেখেন ডাফিয়া দেবী। 

ডাফিয়া দেবীর জন্ম হিন্দু মেঘওয়াল পরিবারে। তখন অবশ্য বিকানির এবং পাঞ্জাবের মধ্যে কোনো কাঁটাতার বসেনি। অখণ্ড ভারতে ‘স্বাধীনতা’ ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, থাকার। তবে তারপরই বেজে উঠল দেশভাগের ঘণ্টা। কতই বা বয়স তখন ডাফিয়া দেবীর। বড়জোর ১৩। পরিবার ঠিক করেছিল বিকানিরে সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলেই নতুন বাসস্থান গড়ে তুলবেন তাঁরা। সেই মতো চলেও আসা গেল ভারতে। কিন্তু পরিবারের থেকে পরিযায়নের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ১৩ বছরের সেই কিশোরী। তারপরই অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই অপহরণ করেন বখশিন্দা খান নামে এক ব্যক্তি। তিনি ডাফিয়া দেবীকে গোলাম রসুলের পুত্র আহমদ বকশের কাছে বিক্রি করে দেন কেবলমাত্র একটি ষাঁড়ের বিনিময়ে। 

বকশ বিবাহ করেছিলেন তাঁকে। ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে ডাফিয়া বাই-ই হয়ে ওঠে আয়েশা বিবি। সুখী পরিবার; তিন পুত্র, চার কন্যা সন্তান নিয়ে সংসারে মন্দ ছিলেন না সেখানে তিনি। তবে স্বজন হারানোর যন্ত্রণাটা দীর্ঘদিন ধরেই তাড়া করে বেড়িয়েছে তাঁকে। অক্লান্তভাবেই তিনি সন্ধান চালিয়ে গেছেন নাড়ির যোগের।

পরিচিতদের কাছে পাকিস্তানে প্রায়ই নিজের ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করতেন ডাফিয়া বাই। জানাতেন ছোটোবেলায় এমন এক জায়গায় তাঁর মামার বাড়ি ছিল যেখানে প্রচুর ময়ূর চড়ে বেড়ায় রাস্তায়। বলতেন তাঁর ভাই-বোনেদের নামও। আর এই গল্পটাই মুখে মুখে ঘুরে পৌঁছেছিল পাকিস্তানি ইউটিউবার মহম্মদ আলমগিরের কাছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসেই তিনি প্রকাশ করেন একটি ইউটিউব ভিডিও। 

দেশভাগের ব্যাপারে কিছু তথ্য খুঁজতে গিয়েই ভিডিওটি চোখে পড়ে দিল্লির এক ব্যবসায়ীর। ভিডিওতে ডাফিয়া বাইয়ের বিবরণ শুনে বিকানিরের বেশ কিছু পরিচিতদের ফেসবুকে ট্যাগ করেন তিনি। অনুরোধ করেন অনুসন্ধানের জন্য। বিকানীর মেঘওয়াল পরিবারগুলিতে খোঁজাখুঁজির পর সেই হারিয়ে যাওয়া সূত্রই যেন জোড়া লাগল আবার। সম্প্রতি ৭৩ বছর পর হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও হল ডাফিয়া বাইয়ের। তবে এত বছরের কথা সহজে কি বলে ফেলা যায়? চোখের জলই তাই জায়গা করে নিল কথোপকথনের অধিকাংশ সময়টাতেই। 

আরও পড়ুন
দেশজুড়ে পথে নামছেন কৃষকেরা, কৃষি বিল কি পালে হাওয়া তুলে দিল বিরোধীদের?

চিরকালই নিজের শিকড়ের সন্ধান করে গেছেন ডাফিয়া বাই। তবে এইভাবে যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা হবে পরিবারের সঙ্গে, তা কল্পনাও করেননি তিনি। শেষ বয়সে এসে ভাই-বোনদের ফিরে পাওয়ায় রীতিমতো আবেগঘন হয়ে পড়েন ডাফিয়া বাই। তবে শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি এখনও। ভারতে পরিবারের বাড়িতে নিজে হাজির হতে চান ডাফিয়া বাই, চান ছুঁয়ে দেখতে নিজের রক্তের সম্পর্কদেরও। তবে তার জন্য দরকার ভিসার। এই মহামারীর পরিস্থিতিতেও সেই সুদিনের কথা ভেবেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি...

Powered by Froala Editor