দক্ষিণ আফ্রিকার নাজারেথ গির্জা। সেখানেই বছরে দু’বার আয়োজিত হয় এক অদ্ভুত অনুষ্ঠান। প্রায় দেড় হাজার সদস্য শিঙ্গা, মাদল বাজাতে বাজাতে চলেন কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশের দিকে তাঁদের পবিত্র মাঠে। মূলত পুরুষরাই অংশ নেন এই উৎসবে। তবে বিষয় হল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের পোশাক। তা দেখলেই চমকে উঠবে যে কেউ। প্রতি নর্তকীর শরীরেই জড়ানো চিতাবাঘের ছাল। কারোর মাথায় ফারের টুপি। যা দেখলেই বোঝা যাবে, ভালুকের ত্বকের ওপরে আটকে দেওয়া হয়ে মহিষের শিং।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সামনে হঠাৎ করে হাজির হয়ে পড়লে প্রশ্ন জাগার কথা, প্রতিবছর এত এত প্রাণীর হত্যা হয়ে চলেছে নির্বিচারে? আসলে বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। বরং এই ‘বিগ ক্যাট’ সুরক্ষা প্রদানের জন্যই এই উৎসব। আর বন্যপ্রাণীদের চামড়া পরিধান করতে দেখছেন, তা আসলে সিন্থেটিকের। দেখে বোঝার উপায় নেই এতটুকু।
তবে নিকট অতীতেও এমন ছিল না এই ছবি। এক সময় সত্যিই বন্যপ্রাণীর ত্বক ব্যবহার করতেন এই জনগোষ্ঠী উৎসবের পোশাক হিসাবে। কিন্তু প্রতি বছরই যে শিকার চলত, এমনটা নয়। একটি ত্বক ব্যবহৃত হয়ে আসত বংশ-পরম্পরায়। তারপর তা নষ্ট হয়ে গেলে আবার নতুন শিকার, নতুন পোশাক।
এখনও অনেকেই এমন আছেন যাঁরা পরিবারে সংরক্ষিত আসল প্রাণীর ত্বকই ব্যবহার করেন পোশাক হিসাবে। তবে দ্রুত পাল্টাচ্ছে পরিস্থিতি। অনুমানিক এক দশক আগে বিশ্বব্যাপী বন্য-বিড়াল সংরক্ষণ সংস্থা ‘প্যান্থেরা’ একটি প্রকল্প নিয়েছিল জনসচেতনতার। ‘ফার্স ফর লাইফ’ নামাঙ্কিত সেই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাপটিস্ট চার্চটিকে। সহযোগিতার এগিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। উপস্থাপন করা হয় সিন্থেটিক ‘লেদার’। এই সিন্থেটিক ‘চামড়া’-র দাম কম হওয়ায় এবং সহজলভ্য হওয়ায় বছর দুয়েকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় আনুষ্ঠানিক এই শিকারযজ্ঞ। আসল চামড়ার বদলে প্লাস্টিক, প্ল্যাডার আর ভিনাইল থেকে তৈরি পোশাকের মাধ্যমেই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেন তাঁরা।
আরও পড়ুন
জমি অধিগ্রহণ, প্রকৃতি-নিধন করে নির্মাণকাজ; প্রতিবাদে লং মার্চ ম্রো জনগোষ্ঠীর
তবে বর্তমানে শুধু ‘প্যান্থেরা’-ই নয়, তার সঙ্গে হাত মিলিয়েই এই প্রচার ও সচেতনতার ক্লাস নিয়ে চলেছেন ব্যাপটিস্ট চার্চের কর্মকর্তারাও। বদলে যাচ্ছে গোটা ছবিটাই। বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় চিতা সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁরাই। হয়ে উঠেছেন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।
আরও পড়ুন
ড্রাগ মাফিয়ার দৌরাত্ম্যে ফুরোচ্ছে জঙ্গলের আয়ু, অস্তিত্বরক্ষার লড়াই কলম্বিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর
প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো যখন বন্যপ্রাণীদের জন্য আপস করতে পারছে নিজেদের সংস্কৃতিকে, তখন সভ্য সমাজ? শুধুমাত্র অর্থ কিংবা বিলাসিতার জন্যই চোরাশিকারের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রাণীদের। তবে নাজারেথের ক্ষেত্রে সিন্থেটিক লেদার সমস্যা সমাধান করলেও, এই সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম সিন্থেটিক ফার। একমাত্র মানসিকতার বদলই রেশ টানতে পারে এই সংঘাতে…
আরও পড়ুন
ছাই হয়ে গেছে অরণ্য, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর
Powered by Froala Editor