সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট দেশ লেসেথো। ছোটো ছোটো গ্রামে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে মানুষের বাস। আর তাঁদের চিরন্তন সঙ্গী হল গান। গত একশো বছরে সেই গানের রীতি অবশ্য অনেকটাই বদলেছে। তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আর সেই আধুনিকতার সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়েছে হিংসাও। আজও গ্রামে গ্রামে মাঝে মাঝেই আয়োজিত হয় গান-বাজনার আসর। তবে সেই আনন্দের রেশ বেশিক্ষণ থাকে না। হয়তো আসর ভাঙার কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, সেখানে পড়ে রয়েছে শিল্পীর মৃতদেহ। এই সমস্ত হিংসার কারণ একটাই। ‘ফামো’ (Famo) নামে এক বিশেষ ধরনের গান। যা আবার লেসেথো (Lesotho) দেশটির নিজস্ব পরিচয়ও বটে।
'ফামো মিউজিকের রানি' নামে পরিচিত পিউসেলেতসো সিমা। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তিনি হয়তো মহিলা বলে বেঁচে যাবেন। কিন্তু এই যুদ্ধে হয়তো একজন পুরুষ ফামো শিল্পীও বাঁচবেন না। তাঁর ভয় হয়, এভাবেই হয়তো সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারাটিও হারিয়ে যাবে। যে ধারাটির জন্মের মুহূর্ত থেকে রয়েছেন তিনি। শুধু কীভাবে এর মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল, সেটা তিনিও জানেন না।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ফামো সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার শুরু। পাহাড়ে যাযাবর এবং পশুপালক মানুষদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই গান। তারপর ক্রমশ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায় ফামো। শিল্পীদের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হতে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট্ট দেশটির অখ্যাত যে-সব মানুষদের কথা কেউ কোনোদিন জানতেও চায়নি, তাঁরাই হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে উঠতে শুরু করলেন। আর এই খ্যাতি থেকেই ছড়িয়ে পড়ল হিংসা। যেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে ফেলতে পারলেই নিজের খ্যাতি আরও বাড়িয়ে তোলা যাবে। আর এক একটি হত্যা আরও বেশি হত্যার সম্ভাবনা তৈরি করে দেয়। অরণ্যবাসী মানুষরা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিশোধ পরায়ন। সেখানে আইনের শাসন কিছুই করতে পারে না।
চারিদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার সীমানা। মাঝে পাহাড়ঘেরা ছোট্ট দেশটিতে জনসংখ্যা মাত্র ২০ লক্ষ। অথচ গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, খুনের হিসাবে পৃথিবীতে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে লেসেথো। আর প্রায় প্রতিটা খুনের নেপথ্যেই রয়েছে ফামো মিউজিক। শুধুমাত্র শিল্পীরাই নয়, শিল্পীদের খুন করতে না পারলে অন্য গোষ্ঠীর লোকেরা এসে তাঁদের পরিবার-পরিজনদের হত্যা করে যান। এমনকি যে সমস্ত শ্রোতারা কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীর গান বেশি ভালোবাসেন, তাঁরাও রেহাই পান না। অ্যাক্রোডিয়নের মতো বাদ্যযন্ত্র ছেড়ে ফামো শিল্পীরা হাতে তুলে নিচ্ছেন বন্দুক। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘gun’। বাংলা বা ইংরেজি, এই দুই ভাষার সঙ্গেই প্রায় অপরিচিত লেসেথোর মানুষ। অথচ ‘গান’ শব্দটির এই দ্বৈত অর্থ সেখানে সত্যিই এক ভয়াবহ বাস্তব হয়ে উঠেছে। আদৌ এই যুদ্ধ কি থামবে কোনোদিন? এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন সকলে। এমনকি যে শিল্পীরা এই হিংসার মধ্যে মেতে উঠেছেন, তাঁদেরও অনেকেই চান না এই পরিস্থিতি। শুধু প্রিয়জনদের মৃত্যু তাঁদেরও বিচলিত করে। এভাবেই প্রতিহিংসা থেকে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুমিছিল।
Powered by Froala Editor