৬ ফুট লম্বা সোজা শিরদাঁড়ার মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালেই একসময় একজোট হতেন জাম্বিয়ার মানুষ। তাঁর বাগ্মীতার গুণে মুগ্ধ হতেন সকলে। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে কেনেথ কুন্দা ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। অথচ জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে সমস্ত জনপ্রিয়তা হারিয়ে একাকিত্বের নির্বাসনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। গত দশ বছরে তাঁকে প্রায় কোনো সভা-সমিতিতেই দেখা যায়নি। আর এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার মৃত্যু হল ‘আফ্রিকার গান্ধী’র। মৃত্যুর সময়েও দেশের মানুষকে পাশে পেলেন না জাম্বিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট।
১৯২৪ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন উত্তর রোডেশিয়ার চিনসালি গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম কেনেথ কুন্দার। তাঁর বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক ও সমাজকর্মী। আর মা রোডেশিয়ার প্রথম শিক্ষিকা। তাই ছোট থেকেই এক ধরনের মুক্ত চিন্তার বাতাবরণে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ১৯৪৩ সালে কুন্দা নিজেও যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষকতায়। লুব্বা শহরের একটি বোর্ডিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালিন হঠাৎ সেই পেশা ছেড়েও দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সলসবেরি শহরের একটি খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে আবারও ফিরলেন শিক্ষকতার পেশায়। ততদিনে অবশ্য স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত দেশ।
ভারতের স্বাধীনতার খবর আফ্রিকার মানুষদের কাছে ছিল এক বিরাট অনুপ্রেরণা। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকেই আঁকড়ে ধরলেন সেখানকার মানুষ। ১৯৪৯ সালে কুন্দার নেতৃত্বেই গড়ে উঠল নর্থার্ন রোডেশিয়ান আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস। প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হলেন হ্যারি নিকাম্বুলা। কুন্দা ও নিকাম্বুলার নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশজুড়ে। বিশেষ করে কুন্দার অসাধারণ বাগ্মিতা প্রভাবিত করেছিল সকলকে। যে কোনো সভায় তিনি উপস্থিত থাকলে মানুষের ভিড় জমে যেত বক্তৃতা শোনার জন্য। এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৫ সালে গ্রেপ্তার হলেন কুন্দা এবং নিকাম্বুলা। তবে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই দুজনের বিরোধ শুরু হল।
সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই কুন্দার একমাত্র লক্ষ্য। অন্যদিকে নিকাম্বুলার মধ্যে ততদিনে এক আপোসকামী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুরনো দল ছেড়ে তৈরি করলেন জামাইকান আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস। ক্রমশ কুন্দাই হয়ে উঠলেন জাম্বিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। আর ১৯৬৪ সালে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হল জাম্বিয়া। গান্ধী এবং লিংকনের সমাজভাবনায় ভর করেই শুরু হল স্বাধীন জাম্বিয়ার জয়যাত্রা।
আরও পড়ুন
এ যেন সত্যিই ‘চাঁদের পাহাড়’, হিরের সন্ধানে ছুটছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অজস্র মানুষ
তবে কিছুদিনের মধ্যেই জাম্বিয়ার অর্থনীতিতে ধস দেখা যায়। বিশেষ করে প্রথমদিকে সে-দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই ছিল তামার ব্যবসা। কিন্তু ৮০-র দশকের শেষ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে তামার দাম কমতে থাকে। এই সময় কুন্দাকে বারবার অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও তিনি সেই সমস্ত কথায় কান দেননি। বরং একে একে তাঁর দলের সহকর্মীদেরই সরকারি পদ থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করলেন কুন্দা। এই স্বৈরাচারী নীতির জন্যই আজ তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এমনকি জাম্বিয়ার বুকে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের পিছনেও তাঁর এই স্বৈরাচারী নীতিকেই দায়ী করেন অনেকে। ১৯৯১ সালে একরকম বলপূর্বক তাঁকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ১৯৯৯ সালে তাঁর নাগরিকত্বও কেড়ে নেয় জাম্বিয়া সরকার। অবশ্য পরের বছরই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু হারানো জনপ্রিয়তা আর ফিরে পাননি কুন্দা। আজকের প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থার স্মৃতি তাঁদের কাছে জীবন্ত। তবু, ইতিহাস ভুলে গেলে তো কোনো মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ণ সম্ভব নয়। জাম্বিয়ার অর্থনৈতিক অবনতির জন্য যদি দায়ী করা হয় কুন্দাকে, তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে, তিনিই দেশের স্বাধীনতারও মূল কারিগর।
আরও পড়ুন
একসঙ্গে ১০টি সন্তানের জন্ম দিয়ে রেকর্ড দক্ষিণ আফ্রিকার মহিলার
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
একুশ শতকেও উপনিবেশ! আফ্রিকার শহর ঘিরে দ্বন্দ্ব স্পেন-মরক্কোর