“কেউ পরিত্যক্ত বাড়িতে, বাড়ির ছাদে কিংবা কাবার্ডে আত্মগোপন করে রয়েছেন। আর একটা বড়ো অংশ ক্রমাগত অবস্থান বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তালিবানদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে। পালিয়ে বাঁচার কাজটাও সহজ নয় খুব একটা। কারণ, তালিবানদের কাছে বায়োমেট্রিকের মতো প্রযুক্তি রয়েছে।”
বলছিলেন প্রথম স্বঘোষিত আফগান সমকামী লেখক নেমাত সাদাত (Nemat Sadat)। গতকাল কলকাতার এলজিবিটি অধিকার সংগঠন ‘প্রান্তকথা’ এবং ‘সায়ান’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল কনফারেন্সে তাঁর গলায় বার বার ফুটে উঠছিল উৎকণ্ঠার সুর। বোঝা যাচ্ছিল, তালিবান-শাসিত (Taliban) আফগানিস্তানে (Afghanistan) এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের (LGBTQ) শত্রু হয়ে উঠেছে প্রায় গোটা সমাজ। তালিবানদের কাছে তাদের তথ্য তুলে না দিলে, প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অন্যদিকে, তাঁদের আশ্রয়দানের ন্যূনতম পদক্ষেপটুকুও নিচ্ছে না পশ্চিমের দেশগুলি।
নেমাতের কথায়, “মার্কিন কিংবা ব্রিটিশ দূতাবাসের কিছু সমকামী আধিকারিকদের শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দেওয়া হলেও, সেখানে তাঁদের এলজিবিটি পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না কোনোভাবেই।”
আফগান সরকার থাকাকালীন সময়েও খুব কিছু স্বাধীনতা পেতেন না এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সমকামিতার অপরাধে খাটতে হত জেলও। ২০১২ সালে কেবলমাত্র সমকামী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য কাবুলের আমেরিকান ইনস্টিটিউট থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল খোদ সাদাতকেই। তার বছর দুয়েক পর তিনি আত্মপ্রকাশ করেন এক্স-মুসলিম হিসাবে। সাদাতের এই সাহসী পদক্ষেপের পর ‘কাম-আউট’ করেছিলেন বহু আফগান সমকামী। আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এক্স-মুসলিম হিসাবে। আফগান সরকার থাকাকালীন সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ছিলেন তাঁরাই। ফ্যাশন শো, রেডিও জকি থেকে শুরু করে স্পা, স্থানীয় মলে সক্রিয়ভাবেই কাজ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের। গোঁড়া ইসলামের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে অনেকেই তাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন খ্রিস্টান, পার্সি কিংবা অন্য ধর্মে। আজ তাঁরাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন তালিবান শাসনে। এই তালিকা থেকে বাদ যান না নাস্তিকরাও। একদিকে যেমন নিজের দেশেই তাঁরা কোণঠাসা, তেমনই অন্যান্য দেশেও তাঁরা আশ্রয় পাচ্ছেন না কেবলমাত্র আফগান হওয়ার কারণে।
আরও পড়ুন
অবশেষে পর্তুগালে ঠাঁই পেলেন আফগান মহিলা ফুটবলাররা
নেমাতের কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠল, আফগানিস্তানের সম্পর্কে এই ধারণার বীজ বপন করেছে আদতে পশ্চিমি দুনিয়াই। তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘যুদ্ধপ্রবণ’ জাতি’ হিসাবে। শুধু পশ্চিমি শিল্প-সাহিত্যেই নয়, আফগান লেখকদের লেখাতেও যেন বার বার ফুটে উঠেছে আফগানিস্তানের সেই অন্ধকার দিকটার কথাই। নিজের লেখায় আফগানিস্তানের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই প্রথাগত চিন্তাধারার বেড়াজালকেই ভেঙেছেন সাদাত। ফুটিয়ে তুলেছেন ইতিবাচক দিকগুলিকে।
আরও পড়ুন
খোঁজ নেই প্রথম মহিলা আফগান গ্রাফিটি শিল্পীর; প্রতিবাদের মাশুল?
তাঁর বক্তব্যেও প্রতিফলিত হল সেই কথাই, “আফগানিস্তানে সত্তরের দশকেও যে গণতন্ত্র ছিল, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই ছিল, সেকথা মনে রাখি না আমরা। উল্লেখিত হয় না মহিলাদের স্বাধীনতার কথাও।” আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার বিগত কুড়ি বছরের সেই লড়াইকেই যেন শেষ করে দিল এক নিমেষে। পশ্চিমা শক্তিগুলি পাশে থাকার আশ্বাস দিলেও, আদৌ কতটা সদর্থক হচ্ছে তাঁদের চেষ্টা তা নিয়ে থেকেই যাচ্ছে সন্দেহ। আফগানিস্তান নিয়ে পাশ্চাত্যের এই ধারণাকেই ভাঙতে চাইছেন নেমাত। কিন্তু বারংবার সাহায্যের আবেদন করেও এখনও পর্যন্ত সেই অর্থে সাড়া পাননি তিনি কোনো শক্তির কাছ থেকেই।
আরও পড়ুন
আফগানিস্তান থেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন ভারতীয় রাজা
কাবুল পতনের পর আফগান এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিরাপত্তা প্রদানে তাই নিজেই মাঠে নেমেছেন নেমাত। সাড়ে চারশোর বেশি এলজিবিটি নাগরিকদের অন্য দেশে স্থানান্তরিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। সেইসঙ্গে তাঁর তালিকায় রয়েছে আরও আড়াইশোর বেশি সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যেই তাঁর সাহায্যে আফগানিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে ইরান, পাকিস্তানের মতো দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ২৫ জন মানুষ। পরবর্তীতে সেখান থেকে তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অন্যত্র।
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সমকামীদের পাশে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক
দিনে প্রায় ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নেমাত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অজস্র মেসেজ, ইমেলের ভিড়ের মধ্যে। তবে এই লড়াইয়ে তিনি একা নন। তাঁর ডাকে কেউ এগিয়ে এসেছেন অর্থ সাহায্য নিয়ে, কেউ পাশে দাঁড়িয়েছেন ভলিন্টিয়ার হিসাবে। এই লড়াই ক্রমশ গোটা বিশ্বের বুকেই ছড়িয়ে পড়বে বলে আশাবাদী তিনি।
Powered by Froala Editor