‘অপরাধ’ টেলিভিশনে কাজ করা, জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা ৩ আফগান মহিলা

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে তখন গোটা শহরজুড়ে। অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ির পথ হাঁটা লাগিয়েছিলেন মুরশাল ওয়াহিদি। আফগানিস্থানের একটি টেলিভিশন স্টেশনের কর্মী তিনি। একাধিক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন চরিত্রে ডাবিং-ই শোনা যায় তাঁরই কণ্ঠস্বর। তবে সেদিন আর বাড়ি ফেরা হল না তাঁর। বরং মেশিনগানের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল রক্তাক্ত দেহ। হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তারকা হওয়ার স্বপ্ন এভাবেই থেমে গেল বছর কুড়ির মুরশালের।

হ্যাঁ, এমনই নৃশংসভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হচ্ছে আফগানিস্থানের টেলিভিশন কর্মীদের। শুধু মুরশালই নয়, একইভাবে নিহত হয়েছেন সাদিয়া সাদাত এবং শেহনাজ নামের আরও দুই কর্মী। দুটি পৃথক ঘটনায় রাতে বাড়ি ফেরার সময় গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। শেহনাজের সঙ্গে সেই ঘটনায় মারা গেছেন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভারও। প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে পূর্ব আফগানিস্থানের জালালাবাদ শহরে।

কিন্তু কেন মরতে হল এতগুলো তাজা প্রাণকে? কী দোষ ছিল তাঁদের? উত্তর একটাই। প্রত্যেকেই মহিলা। আর মহিলা হয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই বিধি ‘লঙ্ঘন’ করেছেন। বাড়ির কাজ না সামলে বহির্জগতের কাজ। সে জন্যই তাঁদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে এমন কঠিন সাজা। হ্যাঁ, হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে এমনটাই জানিয়েছে জঙ্গিসংগঠন আইএস এবং তালিবানরা।

জালালাবাদের শুধু এই টেলিভিশন চ্যানেলের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে মাত্র ১০ জন মহিলাকর্মী ছিলেন এই টিভি-স্টেশনে। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬-এ। তিন মহিলাকর্মী নিহত হয়েছেন জঙ্গিদের গুলিতে। আরও একজন গুরুতর আহত হয়ে ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে।

আরও পড়ুন
স্কুলছাত্রীদের গান গাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, আন্দোলনে পিছু হঠল আফগান সরকার

তবে শুধু টিভি-কর্মীরাই নন, বাইরের কোনো কর্মক্ষেত্রেই নিরাপদ নেই মহিলারা। অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, অধ্যাপিকা, পুলিশি বিভাগে কর্মরত মহিলারাও নিত্যদিন শিকার হয়ে চলেছেন এই চরমপন্থার। গত নভেম্বর মাসে নিহত হয়েছিলেন উচ্চ আদালতের দুই মহিলা বিচারপতিও। 

আরও পড়ুন
চুরি হয়ে যাওয়া সামগ্রী থেকেই তৈরি হচ্ছে আফগানিস্তানের নতুন ইতিহাস

ফেব্রুয়ারি ২০২০-র চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্থান থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তারপর থেকেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তালিবান এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলির দৌরাত্ম্য। তবে এখনও পর্যন্ত আফগানিস্থান থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার করেনি ন্যাটো। রয়েছে আড়াই হাজার মার্কিন সৈনিক-সহ ৯ হাজার সেনা। এখন প্রশ্ন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা চুক্তিতেই কি সহমত হবেন জো বাইডেন? তা-ই যদি হয় তবে ভয়ঙ্কর হতে চলেছে আগামী দিনের পরিস্থিতি।

আরও পড়ুন
আফগানিস্তানের বুকে নিজস্ব ট্যাটু পার্লার, ‘স্বাধীনতা’র লড়াই সোরায়া শাহিদির

কিন্তু এমনই একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় দাঁড়িয়ে কী বলছে আফগানিস্থানের প্রশাসন? রাষ্ট্রপতি আসরাফ গনি-র কথায়, তালিবান সেনার কর্মকাণ্ডে ভীত নন তিনি। সরকার যে ভেঙে পড়বে না সেই আশ্বাসই দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যের ছাপ বিন্দুমাত্রও প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে না আফগানিস্থানের বাস্তব মাটিতে। এক কথায় সমস্ত দিক থেকেই মহিলা এবং শিশুদের সুরক্ষা দিতে যে ব্যর্থ প্রশাসন, সেই কথাই উঠে আসছে জনগণের ক্ষোভের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু কার কাছেই বা আবেদন করবেন তাঁরা? কোথায়ই বা প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হবেন। কারণ, কণ্ঠস্বর তুললেও যে সতর্কতা ছাড়াই চলছে হত্যালীলা। এই চরমপন্থার যে শেষ কোথায়, তা জানা নেই কারোরই। অসহায়তার সঙ্গেই সেই প্রমাদ গুনছেন আফগান মেয়েরা…

Powered by Froala Editor