অন্যান্য দিনের মতোই অফিসের কাজ সামলেই বাড়ি ফেরার পালা। তবে বাড়ি ফেরা হল না আর। গেট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই অন্ধকার হয়ে গেল দৃষ্টি। কারণ চোখের মধ্যেই ততক্ষণ গিঁথে গেছে ধারালো ছুরি। চলেছে গুলিও। রক্তাক্ত অবস্থাতেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন রাস্তায়। তারপর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ, অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে চলা।
সম্প্রতি এমনই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানে। গত অক্টোবর মাসে মধ্য আফগানিস্তানের গজনী প্রদেশে আক্রান্ত হন বছর ৩৩-এর মহিলা খাতেরা। আগে থেকেই অফিসের বাইরে প্রস্তুত ছিলেন আক্রমণকারীরা। আশেপাশের মানুষদের থেকে সাহায্য চাওয়া তো দূরের কথা। দ্রুত ছুটে আসা বাইক থেকে অতর্কিত এই হামলা এতটাই আকস্মিক ছিল, যে সরে দাড়ানোর সুযোগটুকুও পাননি খাতেরা। আর পুলিশ প্রশাসন?
বছর ৩৩-এর খাতেরা নিজেই কাজ করতেন একজন পুলিশ কর্মী হিসাবে। ছিলেন গজনী পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের একজন অফিসার। তবে তাঁর পেশার সূত্রে মনে হতেই পারে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোনো পুরনো শত্রুতা। আর তা থেকেই প্রতিশোধ। কিন্তু আদতে একেবারেই নয় তেমনটা। দোষ, মহিলাদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপন ছেড়ে অফিসের কাজ করতে যাওয়া। আর সেই অপরাধেই সমাজের থেকে পেতে হল এমন শাস্তি। অন্ধ করে দেওয়া হল তাঁকে।
প্রশাসন এবং খাতেরা নিজেও দাবি করেছেন, এই আক্রমণের পিছনে রয়েছে তালিবান গোষ্ঠী। তবে তাদের সাফ দাবি এই আক্রমণের সঙ্গে কোনো রকম যোগ নেই তাদের। বরং তাদের ঘোষণায় ফুটে উঠছে অন্য এক তথ্য। হামলার জন্য দায়ী স্বয়ং খাতেরার বাবা। তিনিই অর্থ দিয়ে ভাড়া করেছিলেন আক্রমণকারীদের।
শুনতে অবাক লাগলেও, এমনটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। এর আগেও আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাস খুঁড়লে এমন ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যাবে অসংখ্য। নিজের কন্যা সন্তান পড়াশোনা করতে চাওয়ায় কুপিয়ে খুব করেছে তার বাবা। এমন ঘটনা ঘটেছে বছর পাঁচেক আগে অবধিও। আর তালিবান মানসিকতা নিয়ে নতুন কিছু না বললেও চলে।
প্রবল পুরুষতন্ত্রের মধ্যে এভাবেই জীবনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন আফগানিস্তানের মহিলারা। স্বতন্ত্র, স্বাধীনতা শব্দগুলো যেখানে শুধুই কল্পজগতের। ২০০১ সালে তালিবান শাসন শেষ হওয়ার পর নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে আফগানিস্তান। বৈষম্য ভাঙতে দেশে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। তবুও কি পাল্টেছে আফগানিস্তানের মানসিকতা? সেই প্রশ্নই যেন ঘুরে ফিরে আসছে বার বার।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ-মানচিত্র বুনতে ঘুরেছেন গোটা দেশ; ‘সত্যান্বেষী’ প্রিয়াঙ্কা দুবে ও এক যন্ত্রণার আখ্যান
তবে মহিলারা এই ধরণের আক্রমণের শিকার হলে, তাতে ততটাও গুরুত্ব দেয় না সমাজ। কারণ এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, আসলে দোষ রয়েছে তাঁদেরই। আঙুল ওঠে মহিলাদের চরিত্রের দিকেই। এখন স্বাভাবিকভাবেই তবে প্রশ্ন উঠবে, সমাজের চোখে তবে আদর্শ মহিলা চরিত্র কেমন? সমাজের অভিমত ‘ভদ্র’ এবং ‘ভালো’ হতে গেলে অবশ্যই গৃহবন্দি থাকতে হবে মহিলাদের। থাকতে হবে বোরখার আড়ালে। যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি চাঁদ কিংবা সূর্যের আলোও, তেমন মহিলাই আদর্শ। এমনটা ধারণা পোষণ করে রাখে আফগানিস্তানের রক্ষণশীল মানসিকতা।
তবে এই মধ্যযুগীর বর্বরতার পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দম্ভ এবং আধিপত্য স্থাপন। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে একজন পুরুষের সমতুল্য হয়ে ওঠার অধিকার কি থাকা উচিত একজন মহিলার? তা একেবারেই নয়। এমনকি নিজের নাম প্রকাশ্যে আনাও গুরুতর অপরাধ তাঁদের ক্ষেত্রে। চিকিৎসার কারণে নিজের নাম প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্যও নির্যাতিত হতে হয়েছে আফগান মহিলাকে। বছর খানেক আগেও সামনে এসেছিল এমন ঘটনা।
খাতায় কলমে কিছুদিন আগেই পাস হয়েছে আইন। এখন সন্তানদের পরিচয়পত্রে থাকবে তাদের মায়ের নামও। কিন্তু আইনি বেড়াজালের বাইরে কতটা উদারমনস্ক হতে পেরেছে আফগান সমাজ, তা নিয়ে থেকেই যায় সন্দেহ। আর প্রশ্ন থেকে যায় সমাজে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে।
আরও পড়ুন
স্কেটিং-এ খুঁজে পাওয়া স্বাধীনতার মন্ত্র, অস্কারের মঞ্চে স্বীকৃতি আফগান মেয়েদের
তবে মহিলাদের সেই লড়াইটা চলছে শিরদাঁড়া সোজা রেখেই। দৃষ্টি হারানোর পরও খাতেরা চান আবার প্রশাসনিক কাজে ফিরতে। যদিও এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত দৃষ্টি ফিরে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব তার পক্ষে। কারণ তিনি চাইলেও সমাজ চক্ষু প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবেই তাঁর কাছে। তবুও দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুধু খাতেরাই নন, অধিকাংশ আফগান মহিলাই এখনও এই লড়ছেন এই যুদ্ধটাই। চাইছেন সমাজের অন্ধত্ব কাটিয়ে আলোর দিশা নিয়ে আসতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য...
Powered by Froala Editor