২০০২ সালের ১৮ আগস্ট। দীর্ঘ তালিবান শাসনের পর আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গণতন্ত্র। গোটা দেশজুড়ে যেন সেদিন পালিত হয়েছিল স্বাধীনতা দিবস। অন্ধকারের আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রথমবার রাস্তায় নেমেছিলেন মহিলারা। তবে তালিবান শাসনকালে শুধুই কি আফগান মহিলারা যন্ত্রণাভোগ করেছিলেন অমানবিকতার? না, বরং সেই অন্ধকার যুগে হিংসা এবং নৃশংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছিলেন সমাজের প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষরা। দু’দশক পর আফগানিস্তানে পুনরায় তালিবান রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর যেন ফিরে আসছে বিশ শতকের শেষের সেই দিনগুলোর আতঙ্ক।
মৌলবাদী সংগঠন তালিবানের বিশ্বাস, সমকামিতা আসলে ইসলাম বিরোধিতা। আর তার শাস্তি ঠিক করা হয় মৃত্যুদণ্ড। না, ফাঁসি নয়; নয় ইলেকট্রিক শক কিংবা শুটিং রেঞ্জে গুলি করে হত্যাও। তালিবানদের সেই মৃত্যুদণ্ডের প্রক্রিয়া শুনলে গা শিউরে উঠবে যে কারোর। মনে হতে পারে যেন হঠাৎ করেই ফিরে গেছেন ঐতিহাসিক গ্ল্যাডিয়েটরের যুগে। শরীরের অর্ধেক অংশ মাটিতে পুঁতে রেখে দূর থেকে ছোঁড়া ইটের আঘাতে শেষ করা হত তরতাজা প্রাণদের। অবশ্য এই প্রক্রিয়ার বিকল্প পথও রেখেছিল তালিবানরা। ২-৩ মিটার উচ্চতার ইটের দেওয়ালের সামনে অপরাধীকে দাঁড় করিয়ে গোড়া থেকে উল্টে দেওয়া হত সেই দেওয়াল। কয়েক টন ওজনের ইটের দেওয়াল চাপা পড়ে প্রায় থেঁতলে যেত মানুষের শরীর।
তবে শুধু সমকামী নয়, তালিবানদের চোখে অপরাধী ছিলেন নারী ও পুরুষের বাইরে সমস্ত ধরনের প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষেরাই। দশ বছরের শাসনকালে প্রায় কয়েক হাজার প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল তালিবানরা। আর তাঁদের বেশিরভাগটাই ছিলেন সমকামী পুরুষ এবং কুইয়ার সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তবে শুধু মৃত্যুদণ্ডই নয়, তালিবান শাসকদের হাতে বন্দি হওয়ার পর চলত দীর্ঘ নির্যাতন প্রক্রিয়া।
২০০১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর সহায়তায় তালিবান রাজত্বের ইতি হওয়ার পর খানিকটা হলেও নিজেদের অধিকারের সম্পর্কে সরব হওয়ার ফুরসৎ পেলেও, সমকামিতা অপরাধ হিসাবেই থেকে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। তবে শরিয়া আইনের সাজা লঘু করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তা কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করেছিল আফগান প্রশাসন। তবে যত দিন গড়িয়েছে ক্রমে বদলেছে আফগান সমাজ এবং প্রশাসনের মানসিকতা।
গত ১৫ আগস্ট দীর্ঘ দুই দশক পর ফের কাবুলের দখল নেয় তালিবানরা। জারি হয় মৌলবাদী ফতোয়া। আর তারপর থেকেই আবার গৃহবন্দি আফগান রমণীরা। অন্যদিকে মৃত্যুভয় জমাট বাঁধছে সমকামীদের মধ্যেও। ইতিমধ্যেই তালিবানদের হুমকি আসতে শুরু করেছে প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষদের কাছে। আত্মগোপন করে থাকলেও, কোনো না কোনো সূত্র ধরে তাঁদের গোপন ঠিকানা খুঁজে বার করা এমন একটা দুঃসাধ্য কাজ নয় মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের কাছে।
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘রেনবো রেলরোড’-এর কাছে ইতিমধ্যেই সাহায্যের আবেদন করেছেন ৬০ জনেরও বেশি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষ। শরণার্থী হিসাবে অন্য দেশে আশ্রয় পাওয়ার জন্যই তাঁদের এই আবেদন। সংখ্যাটা আগামীদিনে কয়েকগুণ হতে পারে বলেই আশঙ্কা আন্তর্জাতিক সংস্থাটির। তবে অনেকের অভিমত সমকামিতার প্রতি সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপন্থী মানসিকতা নিয়েই চলছে তালিবানরা। কিন্তু তাঁদের এই অবস্থান আদৌ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়েই থেকে যাচ্ছে সন্দেহে অবকাশ। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত করার পরেও একটা গোটা দশের ক্ষমতার দখল নিতে পারে যে গোষ্ঠী, পুরনো চরিত্রে ফিরে যাওয়া যে তাঁদের কাছে কেবল সময়ের অপেক্ষামাত্র…
Powered by Froala Editor