‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও

শৈশব যার পকেটে নেই তার পক্ষে প্রতিভার নদীতে সাঁতরাতে যাওয়া বিপজ্জনক - প্রাক-যৌবনে এমন একটি বাণী শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সুদূর মফসসলে এক ঘটনাবিহীন জীবন আমার। কিংবদন্তি যাঁরা, তাঁদের মতো দুরন্ত শৈশব আমার নেই। দেশভাগ নেই, নকশাল নেই এমনকি জরুরি অবস্থার ছায়াও আমার জীবনে পড়েনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যদি বা আছে আমার জীবন দূর থেকে ঘটনাচক্রে তাকে সাদা পাতায় টেনে আনেনি। চায়ের দোকানে বসে আমি শুধু দেখেছি দৃশ্যপট বদলে যায়। গোধূলির আলোয় অবচেতনের বিষাদ কখনও কানে কানে বলে 'কিছুই তো হল না' মাঝে মাঝে ভাবি আত্মজীবনী লেখার কোনো অধিকার আমি পেলাম না। পূর্বাপরহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনার স্মৃতি আছে, অভিঘাত নেই।

তবুও এক স্বতন্ত্র জীবন আছে। কবিতা লিখে লোকাল কবির স্নেহটুকুই মনে হয়েছে যথেষ্ট। তাই মহান কবির বৈঠকখানার ছায়া আমার জীবনে পড়েনি। অথচ সুযোগ ছিল যথেষ্ট। পঞ্চাশের কবিদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমিও কিংবদন্তি কবিদের সাহচর্য পেতাম নিশ্চয়। তবুও মনে হল থাক। আমি দূর থেকেই দেখব কবিদের জীবন। তখনও কবির মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতিগদ্যের এত রমরমা ছিল না। কত স্মৃতি ডুবে গেছে শালুক ফুলের চরাচরে। মফসসলের একটি অজ্ঞাতবাস জীবন নিয়ে বিচ্ছিন্ন হাতের চরাচরে কোনদিক থেকে আলো আসছে বুঝতে পারি না। আমার মণীন্দ্র গুপ্ত নেই, ভাস্কর চক্রবর্তীও নেই। শম্ভু রক্ষিতের শবযাত্রা ছবি আমার পক্ষে এক বিচ্ছিন্ন অথচ জরুরি শুশ্রূষা।

গৌরাঙ্গদেব চক্রবর্তী সম্পাদিত 'তৃণাঙ্কুর' ছিল আমাদের নিজস্ব পত্রিকা। তাঁর নির্দেশে লিখতে হল নবনীতা দেব সেনের কবিতা নিয়ে একটি গদ্য। ডাকে সেই পত্রিকা পাঠানো হল তাঁকে। পৌঁছল কিনা তাও জানি না। কিছুদিন পর বইমেলার এক বিকেলে দেখলাম একা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সামনে গিয়ে পরিচয় দিলাম। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বিশ্বাসই হলনা আমি লিখেছি তাঁকে নিয়ে। খুব খুশি হলেন। তারপর চলল আহ্লাদী আড্ডা। তাঁকে হাত ধরে নিয়ে গেলাম নানা জায়গায়। সেবার 'ক্যাম্প' প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে তাঁর অনবদ্য গদ্যের বই 'ঘুলঘুলি'। সইসহ সেই বই হয়ে রইল স্মৃতিস্মারক। তখন সদ্যে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে হঠাৎ শুরু হয়েছে মহিমা প্রচার। কমন লাগছে জানতে চাইলে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললেন, আমার জীবনে এসবের কোনো মূল্য নেই, লেখাটুকুই আমার পরিচয়। কিছুদিন পর আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁছল একটি পোস্টকার্ড। সেখানে পুনশ্চে নিজের হাতে লিখে দিয়েছেন আমার সঙ্গে পরিচয়ের কথা। দেখলাম তাঁর কলম নিঃসৃত আমার নাম উজ্জ্বল তাকিয়ে আছে মফসসলের আলোয়।

আমার এক বন্ধু পত্রিকা সম্পাদনাসূত্রে কিছুদিন আগেই ঘুরে এসেছে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের বাড়ি। তখন তিনি বেশ অসুস্থ। আমিও তাঁর কবিতা নিয়ে 'তৃণাঙ্কুর' পত্রিকায় সদ্য একটি প্রবন্ধ লিখেছি। তাঁর বাড়িতে গেলাম। হাতে তুলে দিলাম পত্রিকা। অনেকক্ষণ মগ্ন হয়ে পড়লেন। আমি রীতিমতো ভয় পাচ্ছি। যখন চোখ মেলে তাকালেন সেই নৈঃশব্দ্য বলে দিল উতরে গেছি। আমার বন্ধু আগের দিন ছাতা ফেলে এসেছিল। দেখলাম ভোলেননি সেকথা। ফিরে আসার আগে ছাতাটি এগিয়ে দিলেন। এক লালাঝরানো নিঃসঙ্গতার বিষাদ নিয়ে ফিরে এলাম আমরা।

আরও পড়ুন
ট্রেনের কামরায় আঁকা সহজপাঠের ছবি ও কবিতা, চমক শিয়ালদা রেল কর্তৃপক্ষের

গবেষণা শেষ হয়ে গেছে। তবুও একদিন মনে হল শঙ্খ ঘোষের কাছে কিছু তথ্যব শুধরে নেওয়া দরকার। ফোনে যোগাযোগ করে এক রবিবার অনেক সংশয় নিয়ে উপস্থিত হলাম তাঁর ফ্ল্যাটে। দেখলাম অনেকেই এসেছেন। তিনি এলেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত। অনেকেই বই উপহার দিচ্ছেন। ছবি তুলছেন। তিনি নির্বিকার। আমি আমার কথা বলে একটি কাগজে তালিকা মেলে ধরলাম তাঁর সামনে। খুব ধীরে ধীরে বললেন দেরি হবে। কিছুদিন পরে আসতে। একজন সদ্য  উপহার পাওয়া বইগুলি সরিয়ে নিচ্ছিলেন। আমার কাগজটি তাঁর হাত নিতে চাইলেও তিনি কিছুতেই হাতছাড়া করলেন না। একজন অপরিচিত সামান্য গবেষকের জন্যত এই প্রতিরোধটুকুই অক্ষয় হয়ে থাক। পরে আর যাওয়া হয়নি। মনে হল এই ক্লান্ত মানুষটিকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন
কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সংকেত, অবশেষে উদ্ধার ফরেস্ট ফেনের গুপ্তধন

সত্তরের এক কবি পানশালায় বসে আমায় বললেন এই যে 'ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃতনীল পদ্ম লাগি'- এখানে 'নিভৃতনীল' এই শব্দটি রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। এটা আকাশ থেকে পড়েছে। মহৎ কবিদের অনেক শব্দই আকাশ থেকে পড়ে। মনে পড়ল এক মহৎ কবির কথা। যিনি নিজেই একটি মিথ। বিনয় মজুমদার। নব্বইয়ের শুরুতে তাঁকে নিয়ে হঠাৎই শুরু হয়েছে নানা উত্তেজনা - মিথ আর মহিমা প্রচার। ১৯৯৪ সাল। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তাঁর কোনো লেখা না পড়েই শুধুমাত্র মিথ সম্বল করে আমরা কয়েকজন সদ্যআপ্রয়াসী কবিতালেখক পৌঁছে গেলাম তাঁর ঠাকুরনগরের বাড়িতে। সেদিন তিনি বেশ সুস্থ। নিজেই দরজা খুলে বসতে দিলেন আমাদের। তারপর শুরু হল কথা। একই কথা কখনও বারবার বলে চলেছেন। দু-একজন বন্ধুর ছলনার কথা। চাকরি নয় কবিতা লেখার জন্যএই বিনয়ের জন্ম - এই মিথের ফাঁপা রহস্য নিয়ে তাঁর সংশয় প্রকাশ করলেন গোপনে। 

আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কবিতা লিখলেন গুলজার, ছড়িয়ে পড়ল নেট দুনিয়ায়

টুকরো, কখনও অসংলগ্ন, নানা কথার মাঝে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ভালো কবিতা কীভাবে বুঝবে জানো? একটি কবিতা লিখে ফেলে রাখবে। পাঁচ বছর পর যদি তোমার মনে থাকে, বুঝবে সেটাই প্রকৃত ভালো কবিতা। আবার বললেন, 'সবাই বলে উপমা কালিদাসস্য। আমার মনে হয় পঞ্চাশের কবিরাই উপমায় শ্রেষ্ঠ।' ফিরে আসার আগে একটি কবিতা চাইলাম। তখনই কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেললেন। সেই কবিতা হারিয়ে গেছে। আমার কাছে ছিল না। জেরক্সও করা হয়নি। শুধু মনে আছে প্রথম দুটি লাইন 'বেঞ্চের উপর ঐ ছাতাটি রয়েছে/ এ পঙ্কজ চক্রবর্তী আমার সাক্ষাৎকার নিল।' যখন ফিরে আসছি আমাদের দিকে বন্ধ চোখের পাতা মেলে উদাসীন তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। বারান্দায় তখন গোধূলির আলো। আমি দেখলাম এক অনিবার্য, এক অবিশ্বাস্য দাঁড়িয়ে আছেন। মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ থেকে বহুদূরে যেন নিভৃতনীল পদ্ম। এটুকুই কি আমার আত্মজীবনীর পক্ষে যথেষ্ট নয়?

আরও পড়ুন
‘ঘর নেই জমি নেই পেটে নেই ভাত’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় ফুটে ওঠে আজকের পরিস্থিতিই

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কবিতায়-সুরে মনে রাখার আহ্বান, রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি

More From Author See More