হোর্ডিংয়ে নিজের ছবি দেখে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী

বছর আষ্টেক আগে এক শীতকালীন নরম রোদের সকাল। আনন্দবাজারের অধুনালুপ্ত একটি ছোট্ট বিভাগ আমার বড় প্রিয় ছিল। ’৫০ বছর আগে’। কাগজ খুলে চোখ বুলিয়ে নিতে ইচ্ছা করত ইতিহাসে। সেরকমই একটা খবরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংস্করণে চোখ আটকে গিয়েছিল ওইদিন। টাকমাথা এক বৃদ্ধের মুখের ছবি। গ্র্যান্ডফাদার নেক্সট ডোর-মার্কা একটা বড় চেনা মুখভঙ্গি। পাশেই জ্বলজ্বল করছে শিরোনাম- ‘তুলসী চক্রবর্তীর জীবনাবসান’। সঙ্গে খুচরো তথ্য হিসেবে তিনি যে ‘বিশিষ্ট কৌতুকাভিনেতা’ ছিলেন এবং তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২, সেটুকু দেওয়া ছিল সেই মিনিয়েচার ভার্সনটিতে।

আরও পড়ুন
শিং নেড়ে এগিয়ে এল ষাঁড়, একলাফে তিনহাত পিছিয়ে গেলেন সন্তোষ দত্ত

আমার সেই সকালের সদ্য-চেনা তুলসী চক্রবর্তীকে আমি পরে অনেকভাবে চিনতে শিখেছি। তাঁর অভিনীত ছবি, তাঁকে নিয়ে লেখা সত্য ঘটনা, তৈরি হওয়া মিথের মধ্য দিয়ে তাঁর ওই ‘পাশের বাড়ির দাদুর’ চেহারাকে অনেক বেশি স্পষ্ট হতে দেখেছি আমি। সেই অকিঞ্চিৎকর সকালের ছোট্ট ওই প্রতিবেদনটি আস্তে আস্তে ধুলোচাপা পড়েছে, তাও সেদিন প্রতিবেদনটি পড়বার পর মনে মনে তাঁর বয়সের হিসেবটা যে কষে দেখে নিয়েছিলাম যে বেঁচে থাকলে একশো পার করে যেতেন, সেই ভাবনা কিন্তু মাঝে মাঝেই গুহামুখ উন্মোচন করে বেরিয়ে এসেছে।

এহেন তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে তাঁর সহকর্মী থেকে বহু গুণমুগ্ধ মানুষই একটি কথা বারবার বলতেন, অমন প্রতিভাধর অভিনেতাটি বেঁচে থাকতে সেভাবে না পেলেন সম্মান, না পেলেন অর্থ। কিন্তু ঝুটঝামেলাহীন মানুষটি স্বয়ং কোনওদিনই এই না-পাওয়া নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। শিবপুরে তাঁর ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর বাড়ির দৈন্য অবস্থা, পয়সা বাঁচাতে রোজ টালিগঞ্জ থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরা সবই এখন ট্র্যাজিক কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু সেসব নিয়ে প্রকাশ্যে কখনও অভিযোগ ছিল না তাঁর। অভিমানের কথা উঠলেই বলতেন - ‘আমার কতটা কী কেরদানি দেখানোরে ক্ষমতা সেটা তো আমি ভালোই জানি। অভিমানটা আসবে কেন! যেটুকু যা পেয়েছি, এই যে তোমরা পাঁচজন আমাকে ভালোবাসছ, দুটো কথা শুনছ আমার, সেটা আমার বাবা-মা আর জ্যাঠামশায়ের আশীর্বাদের জোরে।’ জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছেই গান ও অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর।

আরও পড়ুন
চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য জহর রায় দাঁড়িপাল্লায় তুলেছিলেন ব্রহ্মাকেও

প্রসাদ চক্রবর্তীর নিজস্ব অর্কেস্ট্রা পার্টি ছিল। ছিল অ্যামেচার ক্লাবও। সেখানেই প্রথম গান গাওয়া শুরু কিশোর তুলসীর। অভিনয়ে কিছুটা পরেই এসেছিলেন তিনি। পরে দল এবং ক্লাব দুটিই উঠে যায়। দল উঠে যাওয়ার পর প্রসাদ চক্রবর্তী স্টার থিয়েটারে হারমোনিয়াম-বাদকের চাকরি নেন। তাঁর খাবার নিয়ে যেতেন তুলসী। সেই সময় উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন মঞ্চাভিনয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের ইচ্ছা সেই থেকেই প্রবল।

একটা সময় স্বাবলম্বী হবেন বলে চিৎপুরপাড়ার একটি মদের চাটের দোকানে বাসন ধোয়ার কাজ করতেন তুলসী। তারপর জ্যাঠামশাইয়ের কড়া বকুনি খেয়ে সে কাজে ইতি। তাঁর কৌলিন্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে জ্যাঠা যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিলেন, তাও রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারতেন তিনি। ব্যর্থ প্রচেষ্টা কারণ, এই বয়-পর্বের পরেই সোজা বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘বোসেস সার্কাস’ দলের সঙ্গে বর্মায় গিয়ে জোকারের কাজে যুক্ত হয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তাঁর হিন্দি ও উর্দু ভাষা শেখা হয়ে গিয়েছিল, যা পরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কাজে দিয়েছে।

বর্মা থেকে ফিরে আসার পর নিযুক্ত হয়েছিলেন চিৎপুরের একটি ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজে। তবে কেবলমাত্র বাসন ধোয়ার কাজটি ছাড়া তাঁর বাকি সব কাজের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল অভিনয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। কম্পোজিটরের কাজ করতে এসে এই আকর্ষণ আরও প্রবল হল। থিয়েটারপাড়ার বড় বড় পোস্টার আর হ্যান্ডবিল ছাপা হত। কুশলীদের ছবি, সঙ্গে ‘আসুন! দেখুন! উন্মুক্ত মঞ্চের উপর শিবের জটাজাল হইতে গঙ্গার আগমন!’-এর আড়ম্বর। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-সাংবাদিক রবি বসুকে বলেছিলেন – ‘কুঁজোরও তো চিত হয়ে শুতে ইচ্ছে হয় গো। তা আমারও মনে হল অভিনেতা হতে পারলে আমারও ওইরকম পোস্টারে নাম ছাপা হবে।’ কিন্তু নিপাট সরলপ্রাণা মানুষটির ভাগ্যে সেরকম প্রচার কোনওদিনই জোটেনি। তাঁর সেই যুবাবয়সের সাধ অপূর্ণই থেকে যেত যদি না সত্যজিৎ রায় থাকতেন।

যে ছবি তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একপ্রকার কৌলিন্য দিয়ে গেছে, সেই ‘পরশ পাথর’-এ সত্যজিৎ তাঁকে যে সম্মান দিয়েছিলেন, তুলসী চক্রবর্তী তা পেয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন ছবির শুটিং চলাকালীন। বলতেন – ‘ব্যাপারটা কী হল বল দিকি! আমাকে নায়ক বানিয়ে ছবি হচ্ছে, এ তো আমি ভাবতেই পারছি না! তাও কিনা সত্যজিৎ রায়ের মতন মানুষের ছবিতে!’ তবে তাঁর অবাক হওয়ার তখনও কিছু বাকি ছিল। ছবি মুক্তির সময় শহর জুড়ে ‘পরশ পাথর’-এর হোর্ডিং পড়েছে। সেখানে সবটা জুড়েই তিনি তুলসী চক্রবর্তী, বা বলা ভাল, তাঁর মুখ। অল্পে খুশি মানুষটি আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন – ‘এইবারে আমি নিঘঘাত পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে তা সেসব মুখ তো দূরবীন দিয়ে খুঁজে বার করতে হত! এ আমি কী হনু রে!’

খাঁটি জহুরি সত্যজিৎ যে আসলে জীবন্ত পরশ পাথরকেই খুঁজে পেয়েছিলেন!

Powered by Froala Editor

More From Author See More