জম্মুর যুবক কুন্দনলালে মুগ্ধ স্বয়ং কবিগুরু, প্রথম অবাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তিনিই

তখন ‘মাই সিস্টার’ ছবির কাজ চলছে। স্টুডিওতে রেকর্ডিং হবে ‘অ্যা-এ কাতিবে তাখদির মুঝে ইতনা বাতা দে’ গানটির। সঙ্গীত পরিচালকের আসনে পঙ্কজ মল্লিক। যিনি গাইছেন, তিনি তখন সুপারস্টার! কুন্দনলাল সায়গল। কিন্তু কিছুতেই ঠিক করে গাইছেন না তিনি। বারবার কথা ভুলে যাচ্ছেন, সুর কাটছে। ততক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন, নেশাটা আজ অতিরিক্ত হয়ে গেছে সায়গলের। কিন্তু পঙ্কজ মল্লিক শুনবেন কেন? যতই তাঁর প্রাণের বন্ধু হোন সায়গল, গান ভুল হবে কেন! সবার সামনে কষিয়ে এক চড় মারলেন তিনি। চড় খেয়ে জ্ঞান ফিরল সায়গলের। প্রথমে খানিক চুপ, তারপর কেঁদে ফেললেন। তারপর যা গাইলেন, সেটা আজ ইতিহাস…

এমনই ছিল সেকালের ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুই কিংবদন্তির বন্ধুত্ব। জম্মুতে জন্ম নেওয়া কুন্দনলাল সায়গল স্রেফ গানের টানে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তখনই আলাপ পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গে। তারপর সিনেমা, আকাশবাণী— কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বও বাড়ছে তাঁর। আর সেই বন্ধুত্বের সেতু হয়ে থেকেছিলেন আরেক বাঙালি পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখনই প্রথম কোনো অবাঙালির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিল বাংলা। আর সায়গলও ডুব দিয়েছিলেন সেই সাগরে।

কে. এল. সায়গলকে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে শুরু করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিকই। শুরুর দিকে বাংলা জানতেন না সায়গল। আস্তে আস্তে শিখে শুরু করলেন গাওয়া। ‘প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে’- এটিই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত। শুরুর সেই দিনটি থেকেই আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন সায়গল। যেন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের আকর। কলকাতার রাস্তায় যখন বাইক নিয়ে ছুটতেন তিনি, তখন সঙ্গে নিতেন শুধু এই গানগুলোকেই। আপন মনে গেয়ে যেতেন। একেক দিন সঙ্গী হতেন পঙ্কজ মল্লিক। এমনও হয়েছে, বাইকে চলতে অনভ্যস্ত পঙ্কজ রাস্তায় পড়ে গেছেন, এদিকে সায়গলের খেয়াল নেই! তখন যে তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে ডুবে আছেন। খেয়াল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ পর!

কুন্দনলাল সায়গলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত
https://www.youtube.com/watch?v=X1e7wEaVbXo

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। একটি ছবিতে সায়গলকে দিয়ে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াতে চান পঙ্কজ মল্লিক। তখনও রবীন্দ্রনাথ বেঁচে। প্রথম একজন অবাঙালি গায়ককে কেমন ভাবে নেবেন গুরুদেব, চিন্তায় ছিলেন পঙ্কজবাবু। রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলে, সায়গল গাইলেন দুটি গান। ‘আমি তোমায় যত’, আর ‘তোমার বীণায় গান ছিল’। শুনে মোহিত হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই যে সায়গল রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পেলেন, মৃত্যু পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথই আশ্রয় ছিল তাঁর।

সারাজীবন গানপাগল ছিলেন সায়গল। ৪২ বছর বয়সে, অসময় চলে না গেলে আরও কত মণিমুক্তো পেত ভারতীয় সিনেমা-জগত। সেই সময়ের আরেক কিংবদন্তি কানন দেবী সায়গল সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- “আজও স্পষ্ট মনে পড়ে সায়গলের গান টেক করবার সময় আমি মেকআপ রুমে থাকলেও ছুটে গিয়ে সব কাজ ফেলে মুগ্ধ হয়ে ওঁর গান শুনতাম। মিষ্টি গলা বলতে যা বোঝায় সায়গলের গলা কিন্তু ঠিক তা ছিল না। ভরাট গলা, দরদভরা মীড়, অতুলনীয় গাইবার ভঙ্গী যেন চুম্বকের মত মনকে টানত। মানুষটিও ছিলেন ভারি চমৎকার। অবসর সময়ে বসে, দাঁড়িয়ে থাকলেই এই আত্মভোলা মানুষটিকে সব সময়ে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে দেখা যেত।”

কুন্দনলাল সায়গলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত
https://www.youtube.com/watch?v=M7mVv1nyDSw

বাস্তবিকই আত্মভোলা ছিলেন তিনি। শুধু গানই ছিল তাঁর যাবতীয় চাওয়া, আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। তখন সবেমাত্র গান শুরু করেছেন, বয়সেও তরুণ। সেই সময় হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে বের হয় তাঁর দুটি গান; ‘ঝুলনা ঝুলাও’ এবং ‘হরি হো ব্রিজ রাজ’। বিনিময়ে ২৫ টাকা পান তিনি। খুব একটা প্রথমে আশা করেননি রেকর্ডিং কোম্পানির মালিক চণ্ডীচরণ সাহা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ লক্ষ রেকর্ড বিক্রি হয়েছে! আরও টাকা দিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু সায়গল কিছুতেই নেবেন না। তাঁর কথায়, সাফল্য তো তাঁরই যিনি তাঁর মতো একজন নবীন গায়ককে দিয়ে গাওয়ানোর ঝুঁকিটা নিয়েছেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কীরকম অবাস্তব লাগে না কথাগুলো?

ঋণস্বীকার-
১) এখন খবর, ‘যুগস্রষ্টা’, রানা চক্রবর্তী
২) অন্যদেশ, ‘বাংলা গানের সেকাল একাল’, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 
৩) বাংলা লাইভ, ‘দীর্ঘ ছিয়াশি বছর ধরে মেষপালক বাঁশি বাজিয়েই চলেছে’

Latest News See More