তাঁবুর নিচে দূতাবাস! ৫০-এ পা দিল অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পীঠস্থান

খোলা মাঠের মধ্যে টাঙানো ছোট্ট একটি ছাতা। তার তলায় বসে চারজন তরুণ। তাঁদের হাতে ধরা ছোটো বড়ো কার্ডবোর্ডের প্ল্যাকার্ড। তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে জমি অধিকারের কথা। ছাতার গায়েও হুবহু একই ধরনের আরও একটি সাইন বোর্ডে লেখা— ‘অ্যাবরিজিনাল এমব্যাসি’ (Aboriginal Embassy)। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন দূতাবাস (Embassy)! পরিচিত যে ঝাঁ চকচকে দূতাবাস দেখে আমরা পরিচিত, তার সঙ্গে কোনো মিলই নেই এই তাঁবুর। কেননা, এই দূতাবাস আদিবাসী মানুষদের। যাঁরা সহস্র বছর আগে থেকে ভূমিসন্তান হলেও, জমির ওপর কোনো অধিকারই নেই তাঁদের। 

১৯৭২ সাল। ২৬ জানুয়ারি। এমনই এক অদ্ভুত দূতাবাসের সাক্ষী হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া (Australia)। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার পার্লামেন্ট হাউসের ঠিক উল্টোদিকের মাঠে রাতারাতি গড়ে উঠেছিল এই দূতাবাস। না, কোনো সরকারি দূতাবাস নয়। বরং, স্বতন্ত্রভাবে এই অস্থায়ী ‘অসাংবিধানিক’ দূতাবাস তৈরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। মূল উদ্যোগের পিছনে ছিলেন টোরেস স্ট্রেট উপজাতির চার তরুণ— মাইকেল অ্যান্ডারসন, বিলি ক্রেগি, টনি কুরে এবং বার্টি উইলিয়ামস। 

১৯৭২ সালে ম্যাকমোহন সরকারের প্রবর্তিত জমি আইনের বিরুদ্ধেই এমন প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন তাঁরা। আদিবাসী মানুষদের ওপর রাষ্ট্রের আগ্রাসন বিশ্বের নজরে আনাই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। বলাইবাহুল্য, এই প্রতিবাদ অবস্থানের ছবি আগুনের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। 

প্রাথমিকভাবে এই প্রতিবাদে কোনোরকম সাড়া দেয়নি অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসন। তা নিয়ে মাথা ব্যথাও ছিল না তাঁদের। তবে কয়েকদিনের পর থেকেই ক্রমশ বদলাতে থাকে দূতাবাসের পরিবেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই স্বতন্ত্র আন্দোলনে সামিল হন অসংখ্য মানুষ। সংখ্যাটা অন্তপক্ষে দুশো তো হবেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন আইন প্রণয়ন করে উচ্ছেদ করা হয় এই দূতাবাসকে। শক্তিশালী প্রশাসনিক বাহিনীর সামনে দানা বাঁধতে পারেনি আদিবাসীদের সেই আন্দোলন। 

আরও পড়ুন
মাকড়সার জালে ঢাকা একাধিক শহর, অবাক করা দৃশ্য অস্ট্রেলিয়ায়

তবে প্রতিবাদ থামেনি। বদলে ভ্রাম্যমাণ দূতাবাসের রূপ নেয় ‘অ্যাবরিজিনাল এমব্যাসি’। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত— দীর্ঘ ২০ বছর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে করে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালানোর পর ১৯৯২ সালে পুনরায় পার্লামেন্টের সামনে ফিরে আসে এই প্রতিবাদ অবস্থান। আর তারপরেই শুরু হয় প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত। পুলিশের লাঠি চার্জে গুরুতরভাবে আহত হন বেশ কিছু মানুষ। তাছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শতাধিক বিক্ষোভকারী। ভাঙচুর চালানো হয় অস্থায়ী দূতাবসে। আর আন্দোলন?

আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ বাঁচাতে স্কুল ধর্মঘটের ডাক ৫০ হাজার পড়ুয়ার

না, সেই আন্দোলন এখনও থামেনি। আজও স্বমহিমায় বিরাজমান টেন্ট এমব্যাসি। উপজাতির মানুষেরা জমির অধিকার পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এখনও কি সাম্য ফিরেছে অস্ট্রেলিয়ায়? সেই বহু-প্রত্যাশিত সাম্যের জন্যই লড়ে চলেছেন তাঁরা। চলতি বছর ২৬ জানুয়ারি, অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন দিবসে, ৫০ বছরে পা দিল ঐতিহাসিক এই আন্দোলন। ৫০-এ পা দিল টেন্ট এমব্যাসিও। বলতে গেলে, অস্ট্রেলিয়ার এই এমব্যাসি বিশ্বের সবথেকে দীর্ঘতম আদিবাসী আন্দোলন। অথচ, আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি এই দূতাবাসের। তবে এই আন্দোলনের দৌলতেই একদিন মূল সংসদভবনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করতে পারবেন, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী আন্দোলনকারীরা… 

আরও পড়ুন
৯১ বছর বয়সেও দাপাচ্ছেন বাইশ গজ, অস্ট্রেলিয়ার সেনসেশন ‘তরুণ’ ডগ ক্রোওয়েল

Powered by Froala Editor

More From Author See More