বয়স তখন মাত্র দশ বছর। শুধুমাত্র ক্রিকেটের নেশাতেই বাবা-মাকে ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা একটা শহরে থাকতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরিচয় হয়েছিল কলকাতার সঙ্গে। নতুন, পরিবেশ, নতুন খাদ্যাভ্যাস, নতুন সংস্কৃতি— সবটা মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিনই ছিল এক কথায়। তবে কলকাতা সবটুকুই দু’হাতে উজাড় করেছিল তাঁকে। আর তিনিও যেন হয়ে নিঃশব্দেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সন্তান। অভিমন্যু ঈশ্বরণ। বাংলার অন্যতম এই তরুণ ক্রিকেট তারকাই এবার ভারতীয় জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়।
আগামী ৪ আগস্ট থেকেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নামতে চলেছে ভারতীয় দল। আর তার ঠিক প্রাকমুহূর্তেই গুরুতর চোট পেলেন ভারতের অন্যতম ওপেনার শুভমান গিল। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে হ্যামস্ট্রিং-এর পেশি ছিঁড়েছে শুভমানের। তবে অস্ত্রোপচার হবে কিনা এখনও পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু জানায়নি বিসিসিআই। আসন্ন ইংল্যান্ড সিরিজে তাই অনিশ্চিত তিনি। আর সেই জায়গাতেই সুযোগ পেতে চলেছেন বাংলার ওপেনার অভিমন্যু ঈশ্বরণ।
রঞ্জি ট্রফি তো বটেই পাশাপাশি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই বিসিসিআই-এর নজরে ছিলেন অভিমন্যু। জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও, তাঁকে স্ট্যান্ডবাই হিসাবেই রেখেছিলেন বোর্ডকর্তারা। এবার প্রথম একাদশে শূন্যস্থান তৈরি হওয়ায় স্ট্যান্ডবাই থেকে জাতীয় দলে ঢুকে পড়তে চলেছে তাঁর নাম। আর সেই সম্ভাবনাই ক্রমশ যেন প্রকট হতে চলেছে। অস্ট্রেলিয়া সফরে যেভাবে নটরাজনের অভিষেক হয়েছিল, সেভাবেই হয়তো ইংল্যান্ডেও চমক দিতে পারেন অভিমন্যু। তবে শুভমানের অনুপস্থিতিতে রোহিতের সঙ্গে ওপেনিং-এ দেখা যেতে পারে মায়াঙ্ক আগারওয়াল বা হনুমা বিহারীকে
১৯৯৫ সালে উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে জন্ম অভিমন্যুর। ছোট থেকেই বড়ো হয়ে ওঠা ক্রিকেটের আবহে। বাবা রঙ্গনাথন ঈশ্বরণও একসময় খেলেছেন বহু ছোটখাটো ঘরোয়া টুর্নামেন্টে। তবে কাজের সূত্রেই আর টিকে থাকা হয়নি ময়দানে। তবে ক্রিকেট নিয়ে এতটুকু খামতি ছিল না স্বপ্নের। স্বপ্ন ছিল নিজের সন্তানই একদিন হয়ে উঠবে সফল ক্রিকেটার।
আরও পড়ুন
১৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়েও অলিম্পিকের মনোনয়ন পর্বে আমেরিকার অ্যাথলিট
রঙ্গনাথন পেশায় ছিলেন চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই ধাক্কা খায় তাঁর ব্যবসা। বাধ্য হয়েই তিনি বন্ধ করে দেন ফার্ম। বদলে সংসার টানতে তৈরি করে ফেলেন একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। ‘অভিমন্যু ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’। তখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি সন্তান। তবু আগে থেকেই সবটা স্বপ্নের মতো করেই গড়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
মেদিনীপুরের প্রণতিকে ঘিরে অলিম্পিকে পদকজয়ের স্বপ্ন ভারতের
বাবার কাছেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি অভিমন্যুর। ছিল প্রতিভাও। তবে প্রথম সারির ক্রিকেটার হয়ে উঠতে গেলে যে পরিকাঠামো দরকার— অভাব ছিল সেটারই। দোসর অর্থের অনটনও। ফলত, সন্তানকে উচ্চমানের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের জন্য কলকাতায় পাঠান তিনি। বাংলার কোচ নির্মল সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে, ব্যবস্থাও হয়ে গেল সবটা। তারপর তাঁর বাড়িতে থেকেই অনুশীলন চালিয়ে গেছেন অভিমন্যু। পরবর্তীতে দেরাদুনে ‘অভিমন্যু ক্রিকেট কোচিং সেন্টার’-এর অবস্থা ফিরলেও বাংলাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এমনকি অন্য দলের হয়ে খেলার সুযোগ থাকলেও রাজ্য দল হিসাবে বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলেন অভিমন্যু। ২০১৩ সালে তাঁর অভিষেক হয় প্রথম সারির ক্রিকেটে।
আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় সাঁতারু হিসাবে সরাসরি অলিম্পিকে সজন প্রকাশ
তারপর যত দিন গেছে ততই যেন ক্ষুরধার হয়েছে তাঁর ব্যাটিং। ফার্সক্লাস ক্রিকেটে ৫৮ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৪ হাজারের বেশি রান। রয়েছে ঝকঝকে ১৪টি সেঞ্চুরি। ২৩৩ রানের এক রঙিন ইনিংসও। ২০১৮-১৯-এর রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে সর্বোচ্চ রান করেন অভিমন্যুই। ছ’ম্যাচে ৮৬১ রান করে টুর্নামেন্টের পারপল ক্যাপের অধিকারীও ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ইন্ডিয়া-এ স্কোয়াডের হয়ে খেলেছিলেন দেওধর ট্রফিতেও। সেখানেও ব্যাটিং বেশ বড়ো সাফল্য। এই ধারাবাহিক পারফর্মেন্সই তাঁকে তুলে এনেছিল জাতীয় দলের স্ট্যান্ডবাই তালিকায়। তবে তারকাদের ভিড়ে উপযুক্ত সুযোগটাই যেন পেয়ে উঠতে পারছিলেন না বাংলার তরুণ। শুভমানের চোটে সেই সোনার চামচ এখন অভিমন্যুর হাতে। আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেকে প্রমাণ করতেও বদ্ধ পরিকর বাংলার ওপেনার। এখন চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে তারই…
Powered by Froala Editor